সময়টা সম্ভবত জুলাই মাসের শেষের দিক। দুই বছর আগের কথা। দেশ জুড়ে তখন করোনার ভয়াবহতা। ঠিক এমন সময় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাগেরহাটের সরকারি পি সি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান স্যার কল করে জানতে চাইলেন, “আজকের আবহাওয়া তো একটু খারাপ। নদীবন্দর গুলোর জন্য কোন সতর্ক সংকেত আছে কিনা। বিশেষ করে মাওয়ায় লঞ্চ চলবে তো। আমার ছেলে টুঙ্গিপাড়ার বাসে খুলনায় আসবে। সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ ঘাটে আসবে। লঞ্চ পারাপার। তুমি আমাকে খবর নিয়ে জানাও। টেনশনে আছি।” এরকম টেনশন সব পরিবার সব মানুষের থাকতো। যারা মাওয়া হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতেন।
আগামী ২৫ জুনের পর আর এই টেনশন থাকবে না। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আর লঞ্চ পারাপার থাকবে না। থাকবে না আর টেনশন। এজন্য প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
তবে মনে একটা সামান্য কষ্ট থেকে যাবে লঞ্চ বা ফেরিতে বসে ভাত, ডাল ফ্রী আর পদ্মার ইলিশ মাছ দিয়ে ভুড়িভোজ আর করতে পারবো না। অনেক গল্পের মত আগামী প্রজন্মের কাছে লঞ্চ ও ফেরি পারাপার এবং খাওয়া দাওয়া রুপকথার গল্প মনে হবে।
তবে আমরা খুলনা তথা বরিশাল ও ফরিদপুরের ২১ টি জেলার মানুষ ভাগ্যবান, আমাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। দীর্ঘ দিনের এপাড় এবং ওপাড়ের বৈষম্য কমে আসবে। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসা বাণিজ্যসহ আবকাঠামোগত ও পরিবেশগত উন্নয়নের। বিনিয়োগ বাড়বে, মোংলা বন্দরে গতিশীলতা আসবে, শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, আমদানী ও রফতানি জন্য মোংলা বন্দর হবে অন্যতম মাধ্যম। সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পে গতি আসবে।
মৃত প্রায় শিল্পনগরী খুলনা আবার নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। খুলনা হবে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্য ও শিল্পনগরী।
পদ্মাসেতু পুরো নাম পদ্মা বহুমুখী সেতু । যেটিতে সড়ক ও রেলপথ রয়েছে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটলো। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হচ্ছে ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট সেতুটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরে রয়েছে একটি একক রেলপথ। সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার আর প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।
এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পদ্মা সেতুর পিলারের পর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। মাওয়া জাজিরা দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে কেন্দ্র ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি হলো। পদ্মা সেতুর ফলে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার (১৭ হাজার বর্গমাইল) যা বাংলাদেশের মোট এলাকার শতকরা ২৯ ভাগ এলাকা জুড়ে ৫ কোটিরও অধিক জনগণ উপকৃত হবে। পদ্মা সেতুতে ভবিষ্যতে গ্যাস এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রাসরণের সুবিধা রয়েছে। এই সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
এই সেতুর ফলে চার ঘন্টারও কম সময়ে যেমন ঢাকায় যাওয়া যাবে। তেমনই ঢাকার কাজ সেরে অল্প সময়ে বাড়ী ফিরে আসা যাবে। অন্যদিকে দৌলতদিয়া ঘাট বা আরিচা ঘাটে ১২/১৪ ঘন্টা অপেক্ষা করা আর লাগবে না।
সূচনা হতে যাচ্ছে নতুন এক অধ্যয়ের। শুরু হবে ইতিহাসের নবযাত্রা। অপেক্ষা শুধু ২৫ জুন। পদ্মাসেতু উপহার দেওয়ার জন্য আবারও ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।