খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ আষাঢ়, ১৪৩১ | ২৩ জুন, ২০২৪

Breaking News

  আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

গ্রন্থ আলোচনা, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি ’

মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি ’
লেখক : বদিউল আলম মজুমদার
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২৩, মূল্য: ৩৩০ টাকা।

বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সঙ্কট প্রধান। সুনিদৃষ্টভাবে বললে কেমন সরকারাধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সে বিষয় নিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্যের অভাবই মূল সঙ্কট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে যখন নির্বাচন হতো, তখন এ সঙ্কট ছিল না। সংকীর্ণ স্বার্থে দলীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বিধান করায় এমন সঙ্কট সৃষ্টি হয়ে দেশ দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতায় পড়েছে। এ সঙ্কটের উত্তরণ নিয়ে জাতি যখন ভাবিত তেমন সময় বদিউল আলম মজুমদার-এর লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি শীর্ষক একটি সময়োপযোগী গ্রস্থ প্রকাশিত হয়েছে।

সময়ের চাহিদা পূরণকারী উল্লিখিত গ্রন্থটি লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ দেওয়া যায়। কারণ, এ গ্রন্থে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নবম সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে সংবিধান সংশোধনের জন্য লোকদেখানো কমিটি করে যেভাবে চাতুরি ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ওই কমিটি, অ্যামিকাস কিউরি ও স্টেকহোল্ডারদের সুপারিশ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার হীন স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে, তা লেখক অনেকটাই দেখাতে পেরেছেন। এ প্রক্রিয়ায় কিভাবে গণভোটের বিষয়টি আমলে না নিয়ে বিচারপতির রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের অপব্যবহার করে দলীয় ব্যবস্থাধীনে সরকার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে সে বিষয়গুলোও লেখক বিবেকবান ও সমঝদার পাঠকদের জন্য বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বাতিলপ্রক্রিয়া বিষয়ে প্রাথমিক ধারণালাভে আগ্রহী তাদের জন্য বইটি প্রয়োজনীয় ও তথ্যপূর্ণ হবে। তবে আলোচ্য গ্রন্থে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় খোলামেলা আলোচনা না করার পেছনে দুরভিসন্ধি আছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক পাঠকগণ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন।

উল্লেখ্য, এ দেশে সর্বসম্মত প্রক্রিয়ায় একটি (বিচারপতি সাহাবুদ্দিন) এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় দুটি (বিচারপতি হাবিবুর এবং বিচারপতি লতিফুর), সর্বমোট তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। লেখক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে আলোচনার সুচনা করলেও তার গ্রন্থে সর্বসম্মতভাবে গঠিত সাহাবুদ্দিন সা‌হে‌বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আলোকপাত করেননি। ছোট করে হলেও গ্রন্থের সূচনাপর্বে এ আলোচনা প্রাসঙ্গিক হতো। তবে আলোচ্য গ্রন্থে একটি অ-তত্ত্বাবধায়ক, অসাংবিধানিক, এবং অবৈধ ফকরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারকে যুগপৎ সর্বসম্মত ও সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সঙ্গে কাতারভুক্ত করে ওই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মর্যাদা দিয়ে পাঠকদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। মূল গ্রন্থ পাঠ শুরুর আগে গ্রন্থটির মলাটের প্রথম ফ্লাপের প্রথম বাক্যদুটিতেই সতর্ক পাঠককে হোঁচট খেতে হবে। ওই বাক্যদ্বয়ে বলা হয়েছে: ‘একটি পরোক্ষ রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি (১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে) জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।’ এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ২০০৮-এর নির্বাচনকালীন সরকারকে সেনা-সমর্থিত সরকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। ওই অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় আনতে যারা পরোক্ষভাবে কাজ করেছিলেন তারাও ওই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেননি। ওই (ফকরুদ্দীন-মইনুদ্দিন) সরকারও কখনো নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করেনি। কাজেই ল্যাংড়া আমকে সাগর কলা বলার মতো দুই বছর মেয়াদি সেনা-সমির্থিত সরকারকে তিন মাস মেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা বড় রকমের ভুল।

১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হবার পর কোন প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে তা সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে লিখিত ছিল। কিন্তু সে প্রক্রিয়া না মেনে সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাব ফকরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার গঠিত হয়। তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন না দিয়ে ভোটের সঙ্গে সম্পর্কহীন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিকে অছিলা বানিয়ে ওই সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। লেখক ২০০৮ সালের অসাংবিধানিক সরকারকে অন্য প্রকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সঙ্গে একই কাতারভুক্ত করে ওই বিতর্কিত সরকারকে জাতে ওঠাবার চাতুরি করেছেন। এ প্রচেষ্টা গ্রন্থের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনপ্রিয়তা’ শীর্ষক সাব হেডিংয়ের আলোচনার সূচনায়ও করা হয়েছে (পৃষ্ঠা-৪৬); উল্লেখিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারাধীনে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে বলার মধ্যেও (পৃষ্ঠা-৬৬)। সতর্ক পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়, লেখক, প্রকাশক এবং গ্রন্থের মুখবন্ধ রচয়িতা যোগসাজসী করে পরিকল্পিতভাবে একটি অবৈধ সেনা-সমর্থিত সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মর্যাদা দিয়ে সত্য এড়াতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তা নাহলে মুখবন্ধ রচয়িতা প্রথম বাক্যেই সাহাবুদ্দিন সরকারকে সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার না বলে ‘অস্থায়ী সরকার’ বলে অভিহিত করতেন না (পৃষ্ঠা-৯)। সাহাবুদ্দিন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না বলে অস্থায়ী সরকার বলার মধ্যে ওই সরকারের প্রতি পরোক্ষ অবহেলা ও তাচ্ছিল্য আছে কিনা তা পাঠককে ভাবিয়ে তুলেছে।

লেখক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের প্রক্রিয়ার ওপর আলোকপাত করেছেন। কিভাবে রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবার ১৬ মাস আগে দ্রুত গতিতে সংবিধান সংশোধন করা হয় সে বিষয়ও তুলে ধরেছেন। প্রধান বিচারপতি তার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে সঙ্গতি না রেখে পূর্ণাঙ্গ রায়ে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টিতে কেন এবং কিভাবে জাতীয় সংসদের অনুমতির প্রসঙ্গটি যুক্ত করলেন সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। তবে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মামালার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রকাশিত হবার পর পূর্ণাঙ্গ রায় ১৫ মাস পরে অবসর গ্রহণ করে বিচারপতির শপথবিহীন অবস্থায় ঘোষণা করা কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে সে বিষয়ে লেখক আলোকপাত করেননি। এমন একটি রায় লিখতে বিচারপতি খাইরুল হকের মতো একজন সুদক্ষ বিচারপতির ১৫ মাস সময় লাগার কারণ সম্পর্কে লেখকের অপ্রতুল আলোকপাত পাঠকের কৌতুহল মেটাতে পারেনি। তার পরেও লেখক গ্রন্থটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাতিল প্রক্রিয়ার অনেক খুঁটিনাটি বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। এতে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অনেকটা একতরফাভাবে একক সিদ্ধান্তে বাতিল করা হয়।

আমি বিশ্বাস করি, বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণের সময় লেখক মুদ্রণজনিত ত্রুটি শুদ্ধকরণের সঙ্গে যদি প্রথম দিকের কতিপয় অংশে এ আলোচনার আলোকে বস্তুনিষ্ঠভাবে কিছুটা পুনঃলিখনের কাজ করেন তাহলে গ্রন্থটি অধিকতর প্রাঠকপ্রিয়তা পাবে। এর পরও যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এর বাতিলপ্রক্রিয়া বিষয়ে নিবিড়ভাবে জানতে বুঝতে চান, তাদের জন্য আলোচ্য বইটি উপকারি হবে বলে আমি মনে করি।

লেখক : সাবেক সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!