খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

গোধূলীর আলো শেষে!

তমালিকা মন্ডল

সব কাব্যে সবসময় ছন্দ থাকে না, কিছু কাব্য অহেতুক ছন্দহীন হয় । এইসব ছন্দহীন কাব্যে লুকিয়ে থাকে কোনো এক গভীর অর্থ কিংবা জীবনবোধ, আমরা মাঝে মধ্যে সেই অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হই, তাই কখনো কখনো এই অর্থ খোঁজার চেষ্টাকে আমাদের বৃথা মনে হয় …।

আমাদের ছোট জীবনটাও হয়তো এক একটি কাব্য, কখনো ছন্দময় আবার কখনো ছন্দহীন, ছন্দহীন অংশগুলোতে কখনো আনন্দ থাকে না, থাকে শুধু রূক্ষ জীবনবোধ, যদিও মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া এই দুইয়ের উপর ভিত্তি করেই চলে জীবন । তবুও তো স্বাধের বাস্তবতা আমাদের, মেনে নিতে পারি না।

এভাবেই পৃথিবীতে আমাদের কাব্যগুলো লেখা হয়, হয়তো আমরা এভাবেই বাঁচি । অনেকদিন পর আবার একটা ভাবের স্ট্যাটাস লিখলাম, ইদানিং যদিও ভাববার সময় নেই কারোর, আমারও নেই। তবে যখন ভাববার সময় আসে তখন একেবারে সব উপচে এসে পড়ে। যাই হোক এই স্ট্যাটাসটা ওত পেতে থাকা বন্ধুদের সীমাহীন পচানী খাবো । সে না হয় খেলাম পচানি। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, অনেক ক্ষুদা লেগেছে, দুপুর ৩ টা বেজে গেছে অথচ বাসায় কোনো বিকার নেই । রান্নাঘরে আধাপাকা চুলের এক ভদ্র মহিলা আনমনা হয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, বয়সের ভারে ভারী হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে এখনো তিনি কিভাবে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে খেটে যান এটাই অজানা এক রহস্য, তবে এই রহস্য পৃথিবীর সকল মায়ের জানা। চুলায় বসানো ভাতের ফ্যান উপছে পড়ছে সেদিকে আমার মায়ের কোনো খেয়ালই আর নেই ।

তিনি জানালা দিয়ে কি যেনো দেখেই যাচ্ছেন, কি যে দেখছেন শুধুমাত্র তিনিই জানেন । মা ইদানিং আনমনা হয়ে যান, দেখলে মনে হয় পৃথিবীর সকল বস্তু থেকেই তার আগ্রহ উঠে গেছে। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে যে, “তিনি কি ভাবছেন ?”

আচ্ছা….আমার মায়ো কি জীবন নিয়ে ক্লান্তিবোধ করে মাঝে মধ্যে ! আমি কখনো জানতে চাইনি। মায়ো হয়তো মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা করে, ফেলে আসা দিনগুলোর সুখস্মৃতি কিংবা হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো নিয়ে, তার সব হারিয়ে ফেলার কিংবা যেতে চাওয়ার কাহিনীগুলো হয়তো লেখা হয় না কাহিনি কিংবা গল্প কিংবা স্ট্যাটাস আকারে। এই ভাবনাগুলো মনের ভিতর এক অদৃশ্য শিকল পরিহিত অবস্থায় থেকে যায় । ঠিক যেন পোষ মানানো পায়রা, যার পালক ছেটে দেয়া হয় যেন বেশি দূরে না যেতে পেরে ঘরে ফিরে আসে । তেতো হলেও কিন্তু সত্যি । আমি বা আমরা সে খবর রাখি না ।

পৃথিবীর সকল ‘মা’ ই এরকম । মোমবাতির মতো গলতে গলতে আমাদের প্রতিনিয়তই আলো দিয়েই চলেন, অন্ধকার না হলে আমরা উনাদের উপস্থিতি টের পাই না কিংবা টের পাওয়ার প্রয়োজন মনে করি না ।

মা……..!!! ভাতের ফ্যান উপছে পড়ছে । এই বলে বড় দিভাই ছুটে এসে গ্যাসের সুইচ অফ করে দেয়। এতক্ষণে হুসে ফিরে আসেন। দিদি জোড় করে মাকে ঘরে পাঠিয়ে দিল। দিদি সহজেই বুঝতে পারে মায়ের মনের অবস্থা, মা চলে যাওয়ার পর দিদি এদিক ঘুড়ে তাকায়। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম আমি কিচ্ছু জানি না। দিদি পাত্তা না দিয়েই অন্য ঘরে চলে গেল। ইদানিং দিদিটার যা ভাব বেড়েছে সব কিছুতেই রাগ রাগ ভাব দেখায়। আগে কত খুনসুটি করত।

এখন আর আমার রুমের ধারে কাছেও আসে না। আবার আমি আশেপাশে ঘুড়লেও কোনো পাত্তা দেয় না। এতে আমার এত্তটাই রাগ হয় যে ওর চুলটাই টেনে ছিড়ে দিতে ইচ্ছা হয়। বাবার গলার খাকারি শুনে আবারো নিজের মধ্যে ফিরি আমি। এটা হচ্ছে দুপুরের খাবার টেবিলে যাওয়ার সংকেত। দিদি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয় আমরা চুপ চাপ খাই। চুপচাপ খাওয়া এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আগের মতো আমাদের মধ্যে আর খুনসুটি হয় না। আগে আমাদের একটা মুরগির ঠ্যাং নিয়ে মারামারি হতো। এই মারামারি শুনে বাবা বলতো আচ্ছা এবার থেকে চার পা ওয়ালা মুরগি আনব। এই কথা শুনে ঝগরার মাঝেও হেসে ফেলতাম দু’জন। তখন আমরা ভাগাভাগি করে খেয়ে নিতাম।আাহা কি সুন্দর মুহুর্ত সেগুলে! খাওয়া শেষে যে যার রুম এ বিশ্রাম নিতে চলে যায়। আমি আর কি করবো অগত্য রুমে বিশ্রাম নেওয়ার বাহানায় একা বসে থাকি। আগে বিকেল হলেই ছাদে গিয়ে জমিয়ে তিনজন মিলে আড্ডা দিতাম। কিন্তু এখন সেটা সোনালি অতীত।মা এখন অনেক নুইয়ে পড়েছেন, এখন আর এত্ত ধকল সহ্য করতে পারেন না। তাই বিকেলেও আগের মত আর রুম থেকে বের হয় না, আর দিদির কথা কি বলবো ওনি তো ফোনে মহা ব্যস্ত। আমি এখন একাকি ছাদে ঘুড়াঘুড়ি করি। পাশের ফ্লাটে একটা ছেলে নাম নিলাদ্র আমাদের মধ্যে মুভি, গেম, কলেজের ফ্রন্ড। এমন কাজ চলতে চলতে কখন মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছে টেরই পাই নি। এখন আর ও ঐ এলাকায় নেই। শুনেছি কি একটা ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তাই ওর বাবা মা ওকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে গেছে। এখন বিকেলগুলো একঘেয়ে লাগে। পশ্চিমের এই লাল আকাশ আমার একদম বিরক্ত লাগে। গৌধুলির এ সময়টা খুবই ভয়ংকার। আমার খুব শান্তনা হয়। তারপর সন্ধা নমলে মা আমার ছবির সামনে আগরবাতি জালায়। মালা বদলে দেয়। দিদি দরজা বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে গান শোনে। বাবা হাটার নাম করে বেরিয়ে যায়। প্রিয় মানুষগুলার সাথে আমার মিছি মিছি থাকার গল্পের সমাপ্তি ঘটে। আমার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছা করে কিন্তু শব্দ বের হয় না। গলায় শব্দ আসে না।  এই কষ্ট প্রিয় মানুষগুলার সাথে কথা না বলতে পারার। তাদের একটু ছুয়ে দিতে না পারার। বুকের একপাশে খুব ব্যথা অনুভব হয়। জীবন মাঝে মধ্যে খুব নিষ্ঠুর হয়। সারা বিকেলে উড়িয়ে চলা ঘুড়ির প্রতি মায়া জমাতেই ছুটে আসতে হয়, তেমনি জীবন মায়ায় জিয়ে হুট করে সুতা টান দেয়।গৌধুলির সময়টা শেষ হতে না হতেই আমার থাকার সময়টা ফুরিয়ে যায়, আগরবাতির ধোয়ার মতো বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকি, আর ঘড়ময় পড়ে থাকে মায়া মায়া গন্ধ।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!