আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। তাই আমি ঘুমাতে পারি না। কখনও আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলে আমি থেমে থাকতে পারি না। তাই আজও লিখছি।
করোনা, করোনা, করোনা!! বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই একটাই। বাংলাদেশেও এই একই আলোচনা চলছে রাতদিন। দিন বললে কিছুটা ভুল হবে। আজকাল দিনটা যেন রাতের চেয়ে অন্ধকার। তারও কারণ সেই করোনা। মানুষ এখন করোনা আতংকে দিনকে রাতের মত বানিয়ে ফেলেছে। যে যেখানে আছে সেই সেখানে করোনা আতংকে থাকে। অবশ্য এর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে।
এমন করোনা আতংককালে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রে মানুষ টাকা খরচ করেও সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বললে ভুল হবে না। করোনা ছাড়াও অন্যান্য রোগীও চিকিৎসা নিতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। অবশ্য এর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন এবং ইতিমধ্যেই তাদের অনেকেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আল্লাহ তাদের সকলের বিদেহী আত্মাকে স্ব স্ব ধর্মীয় মতে শান্তিতে রাখুক।
এরই মাঝে সফলতার সাথে খুমেক হাসপাতালে সম্পন্ন হলো প্রথম কোভিড-১৯ পজিটিভ মায়ের সিজারিয়ান অপারেশন। কোভিড-১৯ পজিটিভ নিয়ে এক প্রসূতি এলেন খুমেক হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে। তার স্বামী ও বাড়ির অনেকেই তখন পজিটিভ। কিন্তু তার প্রসব বেদনা ও বাচ্চার কম নড়াচড়া প্রমান করে প্রসবের সময় আগত ও জটিল। তাকে দ্রুত সিজারিয়ান না করালে মা ও গর্ভের বাচ্চার সমূহ ক্ষতি হতে পারে। খুমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের রেজিষ্ট্রার ডাঃ আছমা তখন ডিউটিতে ছিলেন। প্রাথমিকভাবে পরীক্ষার পরে গাইনী বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডাঃ শামসুন্নাহার লাকি ম্যাডামের সাথে পরামর্শ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সিজারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হাসপাতালের পরিচালক মহোদয়ও বিষয়টি অবহিত হলেন। প্রসূতির বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে ও নিজের স্বামী সহ পরিবারের অনেকেই কোভিড আক্রান্ত থাকায় সকলেই এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন প্রসূতি নিজেও পজিটিভ। তবুও সাহস নিয়ে প্রসূতিকে নিদিষ্ট সময়ে ভর্তি করে নমুনা সংগ্রহ করা হলো। শুরু হলো সিজারিয়ানের সকল প্রস্তুতি।
প্রস্তুত হলেন ডাঃ আছমা ও তার দল। সকল ভয় বাঁধা তুচ্ছ করে প্রসূতি মুসলিমা খাতুনের কোল জুড়ে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে পূত্র সন্তান। জন্মের পর সেই আশঙ্খা সঠিক প্রমান করে প্রসূতির কোভিড পরীক্ষার ফলাফল এলো পজিটিভ। সুতরাং গ্রেট ডাঃ আছমা ও তার দলেরও পরীক্ষা করানো হলো। আল্লাহর রহমতে তাদের ফলাফল ছিল নেগেটিভ। ডাঃ আছমা, তার দল ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আত্মতুষ্টিতে ভাসলেন। সূচনা হলো মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। করোনাকালে সবাই যেখানে ইয়া নাফছি ইয়া নাফছি করছে, সন্তান ফেলে আসছে বাবা-মাকে, সবচেয়ে আপনজন হয়েও কেউ কারো জন্যে এক কদম আগাচ্ছে না; বরং সরাসরি বা কৌশলে দূরে সরে যাচ্ছে। সেখানে ডাঃ আছমা সৃষ্টি করলেন মানবতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই গ্রেট ডাঃ আছমা, তার সহকারী ও খুমেক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য একটা বিশাল স্যালুট জানাই। তাতে ডাঃ আছমা কতটা খুশি হবেন তা জানিনা, তবে আমাদের দায়ভার কিছুটা কমবে। হয়তো আপনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে শত শত ডাঃ আছমা। করোনার ভয়ে বা অজুহাতে যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছে না তারাও হয়তো দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে পারে। যার ফলে সমগ্র জাতি উপকৃত হবে।
কে এই ডাক্তার আছমা
সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা থানার চকমাহমুদালিপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তাঁর। জীবনে কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি এই তুখোড় মেধাবী মানবিক চিকিৎসক। ডক্টরেট ডিগ্রিধারী তার একমাত্র ভাই বুয়েট থেকে পাশ করে বর্তমানে সিঙ্গাপুরে উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত আছেন। ডাঃ আছমা খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৬তম ব্যাচে এমবিবিএস পাশ করেন। ৩৩তম বিসিএস ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বর্তমানে রেজিষ্ট্রার হিসাবে খুমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগে সেবা দিয়ে চলেছেন। তার ডাক্তার স্বামীও একই হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসাবে কর্মরত আছেন। তাদের একমাত্র সন্তান ও বাবা-মা নিয়ে সুখে সাচ্ছন্দ্যে দিন কাটে।
তিনি ইতিমধ্যেই তার পেশায় অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে গাইনীতে এফসিপিএস, এমএস ও এমআরসিওজি (লন্ডন) ডিগ্রী সম্পাদনের শেষ ধাপে আছেন। আমার বিশ্বাস তিনি দেশ বিদেশে আরো প্রশিক্ষণ নিয়ে মানুষের সেবায় আরো বেশি ভূমিকা রাখবেন।
আমি কিভাবে তাকে জানলাম
খুলনা ব্লাড ব্যাংকের একনিষ্ঠ কর্মী স্নেহের আসাদ শেখের ওয়ালে কোভিড-১৯ পজিটিভ প্রসূতির সিজারিয়ানের কাহিনী পড়ে তাকে ফোন করে পুরো ঘটনা জেনেছিলাম। সে আমাকে এই মহান ডাঃ আছমা সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছে। আমি অবাক বিস্ময়ে জেনেছি, এই অকুতোভয় ডাঃ আছমা রোগীর চিকিৎসার স্বার্থে এমন কিছু করেন যা আজকাল কোথাও হয় না। তিনি শুধু ডাক্তার নন, একজন মহান মানুষ। তার সকল গুণের কথা লিখতে গেলে হয়তো কেউ কেউ তাকে হিংসা করবে। প্রিয় আসাদের কাছ থেকে মহান ডাঃ আছমা ম্যামের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তার সাথে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তার বিনয়, প্রচার বিমুখতা, সহকর্মী ও সিনিয়রদের প্রতি সম্মানবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সর্বোপরি আসাদের কাছ থেকে ডাঃ আছমা ম্যামের সকল কর্মকান্ড শুনলে যেকোন মানুষ বলতে বাধ্য হবে, এই যুগে বাংলাদেশে এখনও এমন ডাক্তার আছেন!
প্রসূতির খবর
কোভিড-১৯ পজিটিভ নিয়ে সন্তানসহ সেই প্রসূতি মাতা বাসায় আছেন। তার স্বামী মারাত্মকভাবে কোভিড আক্রান্ত হয়ে ঢাকা সিএমএইচ-এ চিকিৎসারত আছেন। প্রসূতি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তার বিপদের বন্ধু ডাঃ আছমার জন্য দোয়া করছেন। তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, “এই ডাক্তার আপা আমাকে এমন বিপদে সাহায্য করে সারাজীবনের জন্য ঋণী করেছেন। তিনি আমাকে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে নিলেও আমি আমার ও সন্তানের স্বার্থে টাকার বিনিময়ে ক্লিনিকে ভর্তি হতাম। আজকাল সব ডাক্তার তাই করে। কিন্তু এই ডাক্তার আপা আমার করোনা পজিটিভ জেনেও হাসপাতালে সিজারিয়ান করেছেন। আল্লাহ তার জীবন সুন্দর করুক।”
সোনামুখ পরিবারের সম্মাননা
গ্রেট ডাঃ আছমা ম্যামকে নিয়ে স্নেহের আসাদের পোস্ট আমি আমার ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেছিলাম। তাই দেখে সোনামুখ পরিবারের অনেক সদস্য সেটা নিজ নিজ আইডিতে শেয়ার করে। সকল মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হন গ্রেট ডাঃ আছমা ম্যাম। সোনামুখ পরিবারের সকল সদস্য এই মহান মানুষ ডাক্তারকে তার সকল মহান কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা প্রদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই মহান মানুষটি তার মহানুভবতা দিয়ে বিনীতভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে এই করোনাকালে জনসমাবেশও নিষিদ্ধ। শেষ পর্যন্ত এই মহান মানুষটিকে ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে মানবিক দায়িত্ব কিছুটা হলেও পালন করে সোনামুখ পরিবার।
শেষ কথা
জাগ্রত হোক মানবতা। জেগে উঠুক দায়িত্ববোধ। মানুষ যে যেখানে যে কাজ করে তা হোক গ্রেট ডাঃ আছমার মত। দেশ হোক সমৃদ্ধ। আমরা সবাই মানুষ হই।
খুলনা গেজেট / এমএম