খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫
  গাজীপুরের শ্রীপুরে বোতাম তৈরির কারখানায় আগুনে নিহত ১
৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শেখ রাজ্জাক আলী

কাজী মোতাহার রহমান

মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের লোহ মানব জে. আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, ৬৯-৭০ সালে জে. ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে ও জে. এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অকুতভয় সৈনিক শেখ রাজ্জাক আলী। গর্বিত এ রাজনীতিক চির বিদায় নিয়েছেন ২০১৫ সালের ৭ জুন। প্রায় ৬৭ বছর তাঁর কর্মজীবন। আইন ব্যবসা, শিক্ষকতা ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের জন্য আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। সৃজনশীল এ মানুষের অমর সৃষ্টিগুলো মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে রাজ্জাক আলীকে স্মরণ করছে।

কপোতাক্ষ নদের তীরে পাইকগাছার হিতামপুরের সন্তান। মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে দৌলতপুর বিএল কলেজে ভর্তি হন একাদশ শ্রেণিতে। এখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বিএল কলেজে পড়াকালীন ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। হিতামপুরের এ মেধাবী সন্তান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বোচ্চার ছিলেন। সক্রিয় ভূমিক ও সাহসিকতার জন্য বিএল কলেজ ভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য মনোনীত হন, এ কমিটির আহবায়ক ছিলেন ছাত্রলীগের তাহমিদ উদ্দিন। ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন নেমে আসে। তারপরেও বাঙালি জাতির গর্বের বাংলা ভাষার আন্দোলন থেকে পিছ পা হয়নি। জেল, জুলুম, হুলিয়া ও নির্যাতন সহ্য করে শোষকগোষ্ঠীর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সেদিনকার আন্দোলনে বাঙালি জাতি জয়ী হয়।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক জান্তা জে. আইয়ুব খান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে ১৯৫৯ সালের ৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্সিয়াল ওর্ডার নাম্বার ১৩ বলে দ্যা ইলেকটিভ বডি ডিসকোলিফিকেশন অনুযায়ী এবোডা জারি করেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের দুর্নীতি তুলে ধরে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করান। রাজ্জাক আলী তখন ন্যাপের খুলনার একজন সংগঠক হিসেবে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কর্মীদের সংগঠিত করেন। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, জে. আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আট দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ আটটি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ-ডাক নামে জোট গড়ে ওঠে। ডাকের শরিক দলের পক্ষে ন্যাপের এ্যাড. আব্দুল জব্বার, এ্যাড. শেখ রাজ্জাক আলী, এম নূরুল ইসলাম প্রমুখ বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন।

১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ১ এপ্রিল সোয়াতের উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেন। সেনা প্রধান জে. ইয়াহিয়া খাঁন ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানকে দুটো সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দাবিতে পাকিস্তানের বিরোধী দল আন্দোলন গড়ে তোলে। সামরিক সরকার বাধ্য হয়ে নির্বাচন দেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ফলশ্রুতিতে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে অবস্থান করে শেখ রাজ্জাক আলী সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে শাসক দলের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান সিরাজুল আলম খানের জাসদের সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি খুলনা জেলা জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৭৫ সালে কারাবন্দি হন (২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১০ম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনে শোক প্রস্তাব)। শোক প্রস্তাবে বলা হয়, তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুথ্যান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি ১৯৮২-৯০ জেনারেল এইচ এম এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের খুলনার শীর্ষ নেতা। দীর্ঘ ৬৭ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি মানুষের বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে আন্দোলন করেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কারাবরণ ও হুলিয়া মাথায় নিয়েছেন।

১৯৯১ সালের ৫ম সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদীয় সরকারের পক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের আবেদন করেন (ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার রচিত শেখ রাজ্জাক আলী আমার অকৃত্রিম বন্ধু)। শেখ রাজ্জাক আলী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও মাজেদুল হক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে প্রস্তাব উৎথাপন করেন ব্রিটিশ আমল থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চলে আসছে। প্রস্তাব পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে শেখ রাজ্জাক আলীর ওপর দায়িত্ব অর্পন করেন। সংসদে এ প্রস্তাব উৎথাপিত হয়। দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু হয়।

স্পিকার থাকা কালে সংসদে জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য রাখার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে দিতেন। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের ভারসাম্য আনতে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি আজও উদাহরণ। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে গণতন্ত্রমনা মানুষের কাছে তিনি স্মরণীয় ও বরণীয়।

 

খুলনা গেজেট/এমএইচবি




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!