খুলনা, বাংলাদেশ | ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১লা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি

খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার দিঘলিয়া, ক্রীড়াঙ্গনে জৌলুস পাকিস্তান আমল থেকে

একরামুল হোসেন লিপু

একসময়ে ফুটবলার এবং এ্যাথলেট তৈরির সূতিকাগার ছিল খুলনার দিঘলিয়া। বর্তমানে তরুণদের মোবাইলে আসক্তি খেলাধুলার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করছে। ফলশ্রুতিতে তৈরি হচ্ছে না আগের মত খেলোয়াড়।

ক্রীড়াঙ্গনে দিঘলিয়ার জৌলুস সেই পাকিস্তান আমল থেকে। এ্যাথলেটিক্স এবং ফুটবলে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে অংশ নিয়েছেন দিঘলিয়া গ্রামের মরহুম খান জহরুল হক, সাঁতারে মোঃ মোদাচ্ছের হোসেন।

মরহুম খান জহরুল হক ফুটবলে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দলের নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার ছিলেন। এ্যাথলেটিক্সে জাতীয় পর্যায়ে বর্ষা নিক্ষেপ, হাই জাম্প, লং জাম্প এবং পোলভল্টে টানা এক যুগ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রথম স্থান ধরে রেখে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছেন। সাঁতারে মোঃ মোদাচ্ছার হোসেন ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার যৌথভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।

একই গ্রামের মোঃ মিলজার হোসেন ছিলেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের একজন আলোচিত অ্যাথলেট। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। সাফ গেমস, এশিয়ান গেমস, ওয়ার্ড এ্যাথলেটিক্সসহ ২০ টি’র বেশি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ৮০০ মিটার দৌড়ে তার গড়া জাতীয় রেকর্ড ৩৮ বছর পর এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। ৪০০ মিটার স্পিন্টারে তার গড়া রেকর্ড ৩২ বছর পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল।

এ্যাথলেটিক্স এবং ফুটবলে টিপু সুলতান কৃর্তিমান একজন ক্রীড়াবিদ ছিলেন। খুলনা জেলার হয়ে জাতীয় দলে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা সাত বছর এবং ১৯৭৮ সালে জাতীয় যুব ফুটবলে খুলনা জেলার পক্ষে সুনামের সাথে খেলেছেন। এছাড়া ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে ক্লাবের হয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। খেলেছেন ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবললিগে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ফরাসগঞ্জ, রহমতগঞ্জ এমএফএস, পিডব্লিউডি ক্লাবে।

একসময়ে ফুটবলে দিঘলিয়ার ছিল ব্যাপক সুনাম। ছিল স্বর্ণযুগ। ঢাকা প্রথম বিভাগ ও প্রিমিয়াম লীগে এবং খুলনা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে দিঘলিয়ার ফুটবলারদের দাপট ছিল। দিঘলিয়ার অগণিত ফুটবলার প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে খুলনা এবং ঢাকার বিভিন্ন টিমে খেলেছেন সুনাম এবং দাপটের সাথে। এদের মধ্যে ছিলেন মরহুম খান ফজলুল হক, মরহুম খান জহরুল হক, নজরুল ইসলাম, মোল্যা লিয়াকত হোসেন, খান শওকত হোসেন, টিপু সুলতান, মরহুম শহীদ মোড়ল, শহীদ বাওয়ালী, শাহাবুদ্দিন বাওয়ালী, নাসির উদ্দিন বাওয়ালী, মোঃ হানিফ সরদার, মরহুম শেখ আনছার আলী, মরহুম আব্দুর রব লিকু, ফখরুল ইসলাম বাবুল, মোল্যা রেজাউল ইসলাম রিজু, শেখ ফরহাদ হোসেন, মোড়ল মকবুল হোসেন, আব্দুস সালাম বাওয়ালী, মোড়ল কামরুল ইসলাম, খান জাহিদুর রহমান, গাজী মঞ্জুরুল ইসলাম, গাজী জাকির হোসেন, মোঃ মকবুল হোসেন, খান জিয়াউল হক সোহাগ, মোঃ নাসিম শেখ, কানাডা প্রবাসী খান তসলিম আরিফ রাজিব, লন্ডন প্রবাসী বয়লার মোড়ল, মোঃ সাইফুল ইসলাম, শেখ মোঃ আশা, আশরাফুল ইসলাম আশা, রামিম প্রমূখ।

এ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন ইভেন্টে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে ব্যক্তিগত সুনাম এবং কৃতিত্ব অর্জন করেছেন দিঘলিয়ার ২০ জনেরও বেশি এ্যাথলেট। এদের মধ্যে ফুটবল এবং পোলভল্টে দিঘলিয়া গ্রামের মরহুম খান ফজলুল হক, সাঁতার এবং ফুটবলে খান শওকত হোসেন, সাঁতারে মরহুম শেখ মোক্তার হোসেন, শেখ মোজাম্মেল হোসেন, মরহুম সবুর সরদার, ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ এবং একই ইভেন্টে বিজেএমসি’র আন্তঃ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন খান ওলিয়ার রহমান। এছাড়া ৪×১০০ মিটার রিলরেসে পদকপ্রাপ্ত হন।

৪০০ ও ৮০০ মিটার দৌড়ে ফারুক মোড়ল জাতীয় পর্যায়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন। ইটালি প্রবাসী শফিকুর রহমান বুলেট ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়ে জাতীয় রেকর্ড তৈরি করেন। বিজেএমসি’র গড়া সেই রেকর্ড কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।

নাসিমা খাতুন ৪০০ ও ৮০০ মিটার দৌড় এবং ৪×৪০০ মিটার রিলে রেসে জাতীয় পর্যায়ে পদপ্রাপ্ত হন।

শাহাজান মোড়ল জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণজয়ী একজন কৃতি এ্যাথলেট।

জাতীয় পর্যায়ে ৮০০ মিটার দৌড় এবং ৪×৪০০ মিটারে রিলেরেসে মিরা খাতুন কৃতিত্ব অর্জন করেন।

২০০, ৪০০ ও ৮০০ মিটার দৌড়ে মুরাদুল ইসলাম জাতীয় পর্যায়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন।

২০১৯ জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সামিউল রামিম দ্রুততম কিশোর হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।

হাসিম শেখ একজন ভালো দৌড়বিদ ছিলেন। বিজেএমসি’র হয়ে দৌড়ে সুমি খাতুন ২০০ মিটার দৌড়ে জাতীয় পর্যায়ে পদপ্রাপ্ত হন।

সাইকেলিংয়ে সুগন্ধি গ্রামের শেখ নজির আহমেদ, লাখোহাটী গ্রামের হালিম ফকির জাতীয় রেকর্ড তৈরি করেন।

উত্তর চন্দনীমহল গ্রামের মোঃ আমির আলী শেখ জাতীয় অ্যাথলেট ছিলেন। অ্যাথলেটিক্সসে একাধিকবার জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন। বিজেএমসি’র টানা ২২ বছর সিনিয়র কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে জুনিয়র মিটের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

হাজীগ্রামের আব্দুর রশিদ মোল্লা পোলভল্টে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে বিজিএমসি’র চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।

সুগন্ধি গ্রামের মোল্লা আফুরুল ইসলাম খুলনা প্রথম বিভাগ ভলিবল ও ক্রিকেট লীগের একজন ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)’র একজন জাতীয় রেফারি হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন।

শুধু ফুটবলার আর এ্যাথলেট তৈরি নয় দিঘলিয়া থেকে তৈরি হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্তৃক মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বেশ কয়েকজন রেফারী। এদের মধ্যে মোল্লা আফুরুল ইসলাম, মেঃ নাজমুল ইসলাম, শামীমুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, রোমেল বায়েজিদ, রমজান শেখ, রিয়াজ আহমেদ সেতু, বাফুফের মনোনীত ও তৃতীয় শ্রেণীর রেফারি মুনিয়া জাহান ও জোসনা খাতুন।

ক্রীড়া জগতের দিঘলিয়ার সেই সুনাম হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান সময়ে তরুণদের খেলাধুলার প্রতি অনাগ্রহের কারণে আগের মত খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না।

খেলোয়ার তৈরি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে সাবেক কৃতি ফুটবলার ও এ্যাথলেট টিপু সুলতান খুলনা গেজেটকে বলেন, মোবাইলে আসক্ত আর মাদকের কারণে বর্তমান তরুণ সমাজে মারাত্মক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। এ কারণে খেলাধুলার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি খেলাধুলায় দিঘলিয়ার পূর্বের সেই সুনাম, ঐতিহ্য এবং জৌলুস ফিরিয়ে আনার জন্য। এ লক্ষ্যে আমরা এলাকার প্রাক্তন কৃতি ফুটবলারদের নিয়ে সোনালী অতীত ক্লাব গঠন করেছি। গত ১৯ মে থেকে অনূর্ধ্ব ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী ক্ষুদে ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাদেরকে নানাভাবে উৎসাহ এবং সহযোগিতা করছেন।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!