যশোরের যশ খেজুরের রস’ শুধু কথায় নয়, কাজেও। শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। তাই প্রতি বছরের মতো ঐতিহ্যবাহী গুড়-পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। অভয়নগরে অঞ্চলের গাছিরা খেজুরের রস আহরণের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী, ডুমুরতলা, ভোলাপাতা, পায়রা, সমসপুর, একতারপুর, প্রেমবাগ, চেংগুটিয়া অঞ্চলের খেজুরগাছ কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে গাছিরা। গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা তোলা চাচা করার জন্য গাছি দা, দড়ি তৈরিসহ ভাড় (মাটির ঠিলে) ক্রয় ও রস জ্বালানো জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে রয়েছে ব্যতিব্যস্ত।
উপজেলার সমসপুর গ্রামের ইউনুস গাছির ছেলে মফিজ গাছি জানান, তিনি এ বছর ৪শ’ খেজুরগাছ কেটেছে, প্রতিবছর তিনি এ সময়ে গাছ কেটে রস ও গুড় বানিয়ে প্রায় লক্ষাধিক টাকা বিক্রি করেন। এবারো সে রকমই হবে বলে আশা করছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, আমি একা নই, এ গ্রামে আমার মতো বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছে উথান গাছিসহ আরো অনেকে।
এছাড়াও সাবাড়পাড়া গ্রামের গাছি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি এবার ৫শতাধিক খেজুরগাছ কেটেছি, এবারের সিজেনে আমি ১লাখ ৪০ হাজার টাকার রস-গুড় বিক্রি করবো বলে আশা করি।
ধোপাদী, ডুমুরতলার বিষ্ণুপদগাছি, অরবিন্দগাছি, পুর্নগাছিসহ সবাই বলেন, এবার আমাদের গাছ কাটতে বেগ পেতে হচ্ছে, কারণ খেজুরের গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকায় অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস বের করার জন্য করেছেন প্রাথমিক পরিচর্যা। এটাকে গাছ তোলা বলে স্থানীয় ভাষায়। এখানকার বিখ্যাত এ গুড়-পাটালি ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে খেজুর রস থেকে চিনি তৈরি করার জন্য যশোরের ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। যেখানে তৈরি হতো উন্নত মানের চিনি। খেজুরের গুড় থেকে ‘ব্রাউন সুগার’ উৎপাদনেরও সুনাম রয়েছে। তৈরি করা হতো রস দিয়ে উন্নত মানের মদ। অবশ্য খেজুর গাছ আন্যন্য গাছের মতো বপন করা বা সার মাটি দিতে হয় না।
জানা যায়, প্রাকৃতিক নিয়মেই মাঠে পড়ে থাকা খেজুরের আঁটি (বিচি) থেকে চারা জন্মায়। সৃষ্টি হয় খেজুরের বাগান। তবে খেজুর গাছ ইট ভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বেশ আগের থেকে এ অঞ্চলে গুড়, পাটালির উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে। এখন আর আগের মতো মাঠ ভরা খেজুর বাগানও নেই, নেই মাঠে মাঠে রস জ্বালানো বান (চুলো)। যা আছে তা নিতান্তই কম। নলেন গুড়, পাটালি পাওয়া দুষ্কর। এ মৌসুমে যা তৈরি হয় তা রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। আবহমান কাল থেকে তাই বাংলায় নবান্নের উৎসব পালনে খেজুর গুড়ের কদর বেশি।
জানা যায়, এক সপ্তাহ পরই আবার চাছ দিয়ে নলি, গুজা লাগানো হবে। খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে তিন স্তর পেরিয়ে পক্ষকাল পরেই রস আহরণ শুরু হয়। গ্রাম বাংলায় এখন চোখে পড়ছে খেজুর গাছ তোলা চাছার দৃশ্য। গাছিরা এখন মাঠে মাঠে মহা ব্যস্ত সময় পারকরচ্ছেন। কিছুদিন পরই গৌরব আর ঐতিহ্যের মধুবৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে নতুন গুড়, পাটালি তৈরির উৎসব। খেজুরের রস জ্বালিয়ে পিঠা, পায়েস, মুড়ি মুড়কি ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরির করার ধুম পড়বে। আর রসে ভেজা কাচি পোড়া পিঠার (চিতই পিঠা) স্বাদই আলাদা। নলেন গুড়, ঝোলা গুড় ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধ ভোজন। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। নলেন গুড় পাটালির মধ্যে নারিকেল কোরা, তিল ভাজা মিশালে আরো সুস্বাদু লাগে।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, গাছ কাটা, রস জ্বালানো ও গুড়-পাটালি তৈরির উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার অন্য বছরগুলোর তুলনায় গুড়-পাটালির দাম বেশি হবে।এ দিকে যশোর অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের বন বিভাগের উদ্যোগে গত কয়েক বছর আগে খেজুর গাছ রোপণের কাজ শুরু করেছে। ‘বৃহত্তর যশোর জেলার জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে রোপিত হয়েছে খেজুর গাছের সাড়ে তিন লাখ চারা। দেশী জাতের সাথে পরীক্ষামূলকভাবে আরব দেশীয় খেজুরের চারাও রোপণ করা হয়েছে বলে বন বিভাগ জানিয়েছে।
খুলনা গেজেট/এনএম