মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনার পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। দক্ষিণ জনপদে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ, সুস্থ জীবন যাপনের পাশাপাশি শাসকদের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে খুলনার সরকারী গণমাধ্যমের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড প্রচার, চিত্তবিনোদনের জন্য সংস্কৃতির বিকাশ এবং লুকায়িত প্রতিভাকে আলোকিত করার লক্ষে ১৯৬১ সালে খুলনায় রেডিও সেন্টার স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তর পাশে গল্লামারী ব্রীজের পশ্চিমে ও ময়ূর নদের পাড়ে পছন্দ করা হয় রেডিও সেন্টারের জন্য নির্ধারিত স্থান। প্রেসিডেন্ট জেঃ মোঃ আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর কৃষ্ণনগর মৌজায় ৯৬ দশমিক ৯০ একর জমি হুকুম দখল করা হয় (প্রফেসর মোঃ বজলুল করিম রচিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস)। রেডিও সেন্টারের জন্য যে সব এলাকা হুকুম দখল করা হয় সেগুলো হচ্ছে কৃষ্ণনগর মৌজার জে.এল নং- ৮৪, সি এস দাগ নং- পূর্ণ ১৫৬, ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯, ১৬০, ১৬১, ১৬২, ১৬৩, ১৬৫, ১৬৬, ১৬৭, ১৬৮, ১৬৯, ১৭০, ১৭১, ১৭২, ১৭৪, ১৭৫, ১৭৬, ১৭৭, ১৭৮, ১৭৯, ১৮০, ১৮১, ১৮৩, ১৮৪, ১৯৫, ১৯৬, ১৯৭, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২২৩, ২২৪, ২২৫, ২২৬, ২২৭, ২২৮, ২২৯ এবং ১৫৬/৩২১ সিএস দাগ নং- আংশিক ১৮৫, ১৮৬, ১৮৭, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৪ এবং ২২০। পূর্ব পাকিস্তানের শেষ দিকে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট জেঃ আগা ইয়াহিয়া খানের আমলে সীমানা নির্ধারণে কাঁটা তাঁরের বেড়া ও অবকাঠামো নিমার্ণ কাজ শুরু হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে রেডিও সেন্টার ভবন ও ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। গল্লামারী তখন নির্জন এলাকা। নিরালা থেকে গল্লামারী রেডিও স্টেশন পর্যন্ত সড়কের আশে পাশে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। সন্ধ্যার পর শিয়ালের ডাক শোনা যেত। তখনকার দিনে ওই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল ছিল না।
ময়লাপোতা থেকে নিরালা পর্যন্ত পীচের রাস্তা। নিরালা থেকে গল্লামারী পর্যন্ত ইট বিছানো রাস্তা। ব্রীজের পশ্চিম পাশে রেডিও স্টেশনের প্রধান ফটক পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা। রেডিও সেন্টারে প্রবেশের রাস্তাটি ছিল প্রশস্ত। সম্প্রচার ভবনের চারিপাশের ছিল ধান ক্ষেত ও নলখাগড়া বন। নলখাগড়া বনে পদ্ম গোখরা, কেউটে, কাল কেউটে ও ডোরা সাপের বাসস্থান। রেডিও সেন্টার সীমানার মধ্যে দু’চারটি খাল ছিল। মাঘ মাসের পর পানি শুকিয়ে গেলে এই খাল থেকে শিং, মাগুর, শৈল, কৈ, খোলসে ও রানা মাছ পাওয়া যেত। সম্প্রচার ভবনের পেছনে নারিকেল গাছের সারি। মনমুগ্ধকর পরিবেশ ছিল সেখানে।
খুলনা বিভাগের ১৬ জেলা (বরিশাল বিভাগ খুলনার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত) গোপালগঞ্জ মহাকুমা নিয়ে গড়ে ওঠে খুলনা বেতার অঞ্চল। খুলনা রেডিও সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হলে এ অঞ্চলের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, নাট্য সংগঠক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে রেডিও সেন্টার উদ্বোধনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এ সময় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলছিল। পরবর্তীতে ৪ ডিসেম্বর উদ্বোধনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়।
১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে কর্মকর্তা ও কর্মচারী যোগদান করতে শুরু করে। দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। শুরুতেই চেয়ার টেবিল ছিল না। দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানোর জন্য নিউজপ্রিন্ট মিলের কর্মচারীরা কাগজ সরবরাহ করত। সম্প্রচার শুরু হওয়ার আগে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়োগ করা হয়।
আঞ্চলিক পরিচালক (সেন্টারের প্রধান) হিসেবে এম ইব্রাহীম আকন্দ, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে আব্দুল মালেক খান ও আঞ্চলিক প্রকৌশলী হিসেবে বজলুল হালিম চৌধুরী যোগদান করেন। প্রকৌশল বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তারা হলেন আলাউদ্দিন আহমেদ, মাহবুবুর রহমান ও সাদাত হোসেন। অনুষ্ঠান প্রযোজক সামছুর আলী বিশ্বাস, মুন্সী আহসান কবীর, শেখ ওয়ালিউর রহমান, আব্দুস সাত্তার শেখ, অনুষ্ঠান সংগঠক কাজী মাহমুদুর রহমান ও গোলাম কবীর যোগদান করেন।
আব্দুর রহমান নামে একজন দারোয়ান ছিলেন। পাঞ্জাবী জোয়ানদের মত উঁচু লম্বা তার দেহের গঠন (মিউজিশিয়ান শেখ আলী আহমেদ রচিত খুলনা বেতারের জন্ম নামক প্রবন্ধ)।
শিল্পীদের সম্মানী মাসিক দুইশ’ পঁচিশ টাকা এবং কর্মকর্তাদের বেতন তিনশ’ পঁচিশ টাকা থেকে সাড়ে চারশ’ টাকার মধ্যে। প্রথম থেকেই বার্তা বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এ আর শরীফ বার্তা সম্পাদক এবং এম আনিসুর রহমান সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সাবেক উপ-বার্তা নিয়ন্ত্রক আহমেদ রেজা রচিত খুলনা বার্তা বিভাগের ক্রম বিকাশ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভূমিকা শিরোনামের প্রবন্ধে (বার্তা বন্ধন-দুই, ২০১৬) উলে¬খ করেন সংবাদ পাঠক ছিলেন সৈয়দ ঈসা, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী ওবায়দুল হক, সৈয়দা রেহানা আখতার, এ কে এ ফিরোজ নুন, মিয়া মুসা হোসেন, অবাঙালি মঈন পায়ামী প্রমুখ। তখন বেতারের কোনও সংবাদকর্মী ছিলেন না। তথ্য অফিস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল বার্তা বিভাগ। এসব মাধ্যম থেকে আসা খবরই প্রচার হত।