মার্কিন রাজনীতিক ও লেখক Ben Sasse বলেছেন যে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় হল ছাত্র, শিক্ষক, দাতা এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে একটি অংশীদারিত্বের সম্পর্ক, যা একটি সাংস্কৃতিক কমিউনিটি বা সম্প্রদায় গঠন করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একটি অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় ছিল। বিশেষত শিল্পাঞ্চল খুলনার উচ্চ শিক্ষার বিষয়টি এ অঞ্চলের শিক্ষানুরাগী সচেতন মহল বেশ গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করে এবং এক পর্যায়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরও একটি প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের শিল্প অর্থনীতিতে খুলনার একটা বিশেষ অবদান ঔপোনিবেশিককাল থেকেই দৃশ্যমান। এখানে যে অভাবটি সবার কাছেই উপজীব্য হয়ে ওঠে তা হল একটি উচ্চ শিক্ষাগার প্রতিষ্ঠার । ইতোমধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রামসহ প্রায় সবকটি বিভাগীয় শহরে কয়েকটি পাবলিক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও বিভাগীয় শহর খুলনায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে খুলনা জেলা স্কুল, করোনেশন হাই স্কুল, বিএল কলেজ, আযম খান কমার্স কলেজসহ বেশকিছু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল কলেজে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম চলে এসেছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেন খুলনার মানুষের কাছে স্বপ্নই রয়ে যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথম ড. কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের ১৩ অধ্যায়ের ১৩.৫২ অনুচ্ছেদে খুলনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশসম্বলিত ধারা সংযোজিত হয়।
কিন্তু ৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ড. কুদরত-ই খুদা কমিশনের সুপারিশমালা কার্যকর হয়নি। ১৯৭৯ সালে খুলনাবাসীর সংঘবদ্ধ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভা খুলনায় একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু খুলনার বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ সংঘবন্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে (বাংলাপিডিয়া)।
পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে জেনারেল এরশাদ খুলনা সফর করেন এবং খুলনার হাদিস পার্কে এক জনসভায় খুলনাবাসীর পক্ষ থেকে জেনারেল এরশাদের নিকট কিছু দাবি উপস্থাপন করা হয় । এই দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল খুলনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু দাবি বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে খুলনাবাসী ১৯৮৫ সালের ১০ আগষ্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন সমন্বয় কমিটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এই সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে খুলনাবাসী গল্লামারীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলক উন্মোচন করে। এই দৃশ্য বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রচার করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হয়।
১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করা হয়। ১৯৯০ সালের জুলাই মাসে জাতীয় সংসদে ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯০’ পাস হয়, যা গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ওই বছর ৩১ জুলাই। ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর শিক্ষাকার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
এর আগে ১৯৮৫ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সরকার কারিগরি সম্ভাব্যতা এবং শিক্ষা কার্যক্রমের রুপরেখা প্রণয়নের জন্য দুটি কমিটি গঠন করে। যাদের প্রধান ছিলেন যথাক্রমে সচিব মহবুবুজ্জামান এবং শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। প্রথম কমিটি যাচাইবাছাই শেষে খুলনা রেডিওর কার্যালয় গল্লামারীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্থান হিসেবে নির্বাচন করে।
সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গণদাবি এবং গণ-আন্দোলন সচরাচর ইতিহাসে বিরল। খুলনাবাসীর খুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গণ-আন্দোলন প্রমাণ করে খুলনাবাসীর উচ্চশিক্ষার প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ এবং উন্নত সচেতনতাবোধকে। আসলে খুলনাবাসী অনুধাবন করেছিল যে, একটা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল বিশালাকার কিছু ইমারত আর বড় ক্যানভাসের সম্মিলন নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় একটি অঞ্চলের শারীরিক এবং আত্ত্বিক উৎকর্ষকে ধারণ এবং লালন করে। বিশ্ববিদ্যালয় যেমন নব নব আবিষ্কার আর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে যার উদ্দেশ্য হল সুন্দর, উন্নত এবং অগ্রসরমান জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া তেমনিভাবে সেই বিজ্ঞানের সুফলকে মানবকল্যাণে কাজে লাগাতে সুন্দর ও মঙ্গলময় মনন তৈরি করে। অর্থাৎ এমন একটি সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় সৃষ্টি করা যা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সার্বজনীনতাকে লালন করে সুবিন্যস্ত সমাজের পথচলাকে উৎসাহিত করে। আজকের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই লক্ষ্যকে ধারন করেই বৈজ্ঞানিক এবং মানবিক অগ্রগতির চর্চা করে যাচ্ছে। বিজ্ঞান, সমাজ, সংস্কৃতির আন্তঃমিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম জায়গা করে নিয়েছে খুলনাবাসীর প্রাণের স্পন্দন এই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাদিবসে এটাই হোক আহবান যে প্রকৃত শিক্ষা এবং জ্ঞাণচর্চা, জ্ঞাণ বিতরণ এবং জ্ঞানসৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে যাক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাসম্বলিত বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।