অগ্নিঝরা একাত্তর। মার্চের শুরু থেকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। খুলনা সার্কিট হাউস, কালেক্টরেট ভবন ছাড়া সর্বত্র কালো পতাকা উড়ছে। তখনকার দিনে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে দৌলতপুর বিএল কলেজ। বিএল কলেজের ছাত্ররা ক্লাস, পরীক্ষা ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। কমার্স, সিটি, সুন্দরবন, সরকারি মহিলা মহাবিদালয়, জিলা স্কুল, সেন্ট যোসেফস, করোনেশন, মডেল, বি কে স্কুল, মহসিন স্কুল ও পল্লীমঙ্গল স্কুল বন্ধ। অফিস আদালত বন্ধ। রূপসা, দৌলতপুর ও খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ফেরিঘাট, বানিয়াখামার ও খালিশপুরের বিহারীরা পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার লক্ষে সেনাবাহিনীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। বাঙালি ও বিহারী একে অপরের প্রতিপক্ষ।
খুলনা শহর জুড়ে স্লোগান ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। খুলনা শহরের নতুন বাজার, বড় বাজার, শেখপাড়া বাজার, দোলখোলা বাজার, আলমনগর, চিত্রালী ও দৌলতপুর কাঁচা বাজার খোলা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সদর দপ্তর সার্কিট হাউসে। এছাড়া শিপইয়ার্ড, রুজভেল্ট জেটি, নূরনগর ওয়াপদা, পিএমজি-তে সেনা ছাউনী। গল্লামারীতে অবস্থিত রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্রেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর খুলনাস্থ অধিনায়ক (অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে) লে. কর্নেল শামস উল জামান।
২৫ মার্চ আলোচনা অসমাপ্ত রেখে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান অতি গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। যশোর সেনানিবাস থেকে সৈন্য খুলনায় এনে শক্তি বাড়ানো হচ্ছে। ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার। খুলনা শহর নিস্তব্ধ। মধ্যরাতের নিরবতা ভেঙ্গে ঢাকা থেকে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর খুলনা শহর শাখার প্রধান মীর্জা খয়বারের বয়রাস্থ বাসায় টেলিফোন আসে। ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানানো হয় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন। টেলিফোনে বলা হয় যত দ্রুত সম্ভব স্বাধীনতার ঘোষণা যেন খুলনাবাসিকে জানানো হয়।
খুলনাবাসী এমন একটি ঘোষণার জন্য প্রত্যাশার প্রহর গুনছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি ছিল-
Declaration of Independence:
This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last, your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. Joy Bangla.
Sheikh Mujibur Rahman.
[The declaration was recorded and sent to the central telephone office at 10:30 p.m. It was transmitted all over Bangladesh through T & T wireless after midnight and onwards. As soon as the message reached destinations wireless operators on duty reached out it to the local Awami League leaders as telegram. The message was first monitored by Pakistanis at a frequency close to that of Dhaka Radio. It was also transmitted through East Pakistan Rifles’ wireless.
(সূত্র : বাংলাদেশ বেতার, খুলনা কেন্দ্র প্রাঙ্গণে স্থাপিত ফলক অসহযোগ আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীনতার সূর্য তোরণ)।
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতি সমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসরাদের সাহায্য চান। কোন আপোস নেই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশ প্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
মীর্জা খয়বার হোসেন এই ঘোষণা পাওয়ার পর পরই রাতে নিজেই রিক্সাযোগে মাইকিং করে বয়রাবাসিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা জানান।
মীর্জা খয়বার হোসেনের স্ত্রী ৭৫ বছর বয়সী মিসেস করিমা খাতুন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে বৌমা বলে ডাকতেন। একদিন কচুরমুখী, গলদা চিংড়ি আর নারিকেলের দুধ দিয়ে ভুনা করে বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্না তরকারি শেখ আবু নাসের ভাইয়ের বাড়ীতে পাঠাই। স্বাধীনতার পূর্বে দু’বার বঙ্গবন্ধু বড় বয়রার মীর্জা বাড়িতে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুলনায় আসলে মাঝে মধ্যে আমাদের পরিবারের উইল্স নামক গাড়ীতে চড়তেন।
মীর্জা খয়বার হোসেন বড় বয়রা এলাকার সোলায়মান মীর্জার পুত্র। তিনি স্বাধীনতা পূর্বকালে খুলনা শহর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন। খুলনায় প্রকাশ্যে ২৬ মার্চ প্রথমে বৈকালীতে পরে সরকারি মহাবিদ্যালয়ের মোড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেন। বয়রা পুলিশ ক্যাম্প থেকে ও কেডি ঘোষ রোডস্থ সৈয়দ মোল্লার দোকান থেকে সংগ্রহ করা বন্দুক নিয়ে এই যুুদ্ধে অংশ নেন। পরে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে খুলনা ত্যাগ করেন। তিনি ভারতের তেতরা ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। তাঁর ভাই মীর্জা আফজাল হোসেন ও মীর্জা তসলিম হোসেন একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর খুলনা রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন। এক সময় শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, শিশু ফাউন্ডেশনের মহাসচিব (১৯৮৩-৮৫) ছিলেন। ১৯৮৪ সালের দিকে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালের ২৫ জুলাই ইন্তেকাল করেন।