খুলনা শহরের হেলিপোর্ট ও ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হত, তা দেখে খুলনার তৎকালীন জেলা জজ হার্টফেল করে মারা যান। বর্তমানে হেলিপোর্ট ফরেস্ট ঘাটের কথা বলা যাক।
হেলিপোর্ট জজ কোর্টের সামনে এবং সার্কিট হাউস সংলগ্ন। যে সব বাঙালির ওপর তাদের অত্যাধিক রাগ ছিল তাদের প্রকাশ্য দিবালোকে হেলিপোর্টের প্রবেশ পথে ছাগল ধরা করে পা ওপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখত।
আর ঐ অবস্থায় চলত অত্যাচার, চড়, ঘুষি ও চাবুকের আঘাত। কোন কোন ক্ষেত্রে ঐ অবস্থার ওপর বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হত। যতক্ষণ না সে মারা যায় ততক্ষণ চলত এই নির্যাতন। যার কাছ থেকে কোন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হত ঐ ভাবে অত্যাচার করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে নামানো হত, জ্ঞান ফিরলে আবার ঝোলানো হত পূর্ববৎ।
একদিন আমার নিজের দেখা একটি মৃত্যুর কথা উল্লে¬খ করছি। সকাল ১০টা হবে। হেলিপোর্টে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা দীর্ঘ সবল দেহী এক বাঙালির পায়ে, হাটুতে ও অন্যান্য গিরায় তাকে রোলার দিয়ে দু’জন সেনা পিটাচ্ছেন আর দু‘ জন সেনা তা উপভোগ করছে। যার ওপর অত্যাচার চলছে তিনি বার বার বাধা দিচ্ছেন আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তারপর তার দু’পায়ে দড়ি বেঁধে পা ওপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলানো হল।
পরণে থাকল জঙ্গিয়া ও গায়ে গেঞ্জী। পরে খালি গা করে গেঞ্জিটিও অপসারণ করা হল। আর চলল চাবুকের বাড়ি। প্রতিটির বাড়ির সাথে সাথে তার দেহটি মুচড়ে উঠতে লাগলো। এ ঝুলন্ত অবস্থায় তিনি হাত দিয়ে বাঁধা দিচ্ছেলেন। কিন্তু পরে আর তার হাতে সে জোর রইল না। কিন্তু চাবুকের বাড়ি চলল অব্যাহতভাবে। আর এভাবেই সমাপ্তি হল একটি বাঙালি জীবন। পরে তার সেই ঠান্ডা শীতল দেহটাকে নামিয়ে অবজ্ঞায় তারা দূরে ফেলে দিল- আবার অপর একজনকে। আমি সরে পড়লাম।
রাতের বেলায় জজ কোর্টের পেছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের এনে জবাই করে হত্যা করা হত এবং দেহগুলোর পেট চিরে নদীতে ফেলা হত। ঘাটটি আবার জেলা জজ সাহেবের বাসার ঠিক পেছনেই। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই সব মৃত্যু পথযাত্রী বাঙালিদের করুণ আর্তনাদ জজ সাহেবের কানে পৌঁছাতো। দিনে হেলিপোর্টে ও রাতে ফরেস্ট ঘাটের সেই সব হত্যাযজ্ঞ সহ্য করতে না পেরে জজ সাহেব তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে অনুরোধ করেছিলেন যে বিচালয়ের সামনে এ ধরণের কাজ না করা হয়। তার উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুর শাসানি। কিন্তু তাদের সে স্বাদ মেটেনি। তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এক রাতে মারা গেলেন।
আরেকটি বধ্যভূমি ছিল গল্লামারী। খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড় মাইল। হেলিপোর্ট, ফরেস্টঘাট, কাষ্টমসঘাট প্রভৃতি জায়গায় প্রথমে বাঙালিদের হত্যার জন্য বেছে নিলেও পরে বর্বর পাকবাহিনী গল্লামারীতে তাদের নৃশংসতার উপযুক্ত স্থান বলে বেছে নিয়েছিল।
সারাদিন ধরে শহর ও গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে জেলখানা, হেলিপোর্ট ও ইউএফডি ক্লাবে জমায়েত করা হত। তারপর মধ্যরাত হলে সেই হতভাগ্য নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা তারা ব্রাশ মারত, রক্তাপত দেহে লুটিয়ে পড়ত হতভাগ্যরা।
হত্যার আগে ট্রাক ভরে যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হত। তখন সেই সব নিরুপায় মানুষের আর্তনাদ রাস্তার আশেপাশের সবাই শুনত। কিন্তু তাদের তো বাড়ির বাইরে যাওয়ার উপায় নেই- কারফিউ রয়েছে।
সেই আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে শের-এ-বাংলা রোডের এক ব্যক্তি জানালা খুলে মুখ বাড়িয়েছিল মাত্র। ব্যাস, অমনি তাকে লক্ষ্য করে হানাদার বাহিনী গুলি ছুঁড়লো আর বুলেটবিদ্ধ হয়ে সে লুটিয়ে পড়ল। হানাদার বাহিনী প্রতি রাত্রে কম করেও শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনের বেলায় তাদের লাশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসত। কিন্তু কারও সাহস হত না তাদের দাফন করার।
অনেকে তাদের আপনজনের লাশ সনাক্ত করলেও সেখান থেকে তাকে উঠিয়ে নিতে পারেনি। কেননা বর্বরেরা জানতে পারলে তাকেও হত্যা করবে। কিছুদিন জল¬াদরা ঠিক করল গুলি করে আর হত্যা নয়। অন্য পন্থা। এবার থেকে শুরু হল জবাই, কিন্তু সংখ্যায় কমলোনা-সেই শতাধিক প্রতি রাতে। এর পরের ঘটনা চরম নিষ্ঠুরতার রাতের বদলে হত্যার জন্য দিনের বেলাকেও বেছে নিল।
সকলের চোখের সামনে দিনে পিঠ মোড়া দেয়া ট্রাক ভর্তি বাঙালি নিয়ে যাওয়া হত আর ঘন্টা খানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসত- গল্লামারীতে পড়ে রইত কিছুক্ষণ আগের যাওয়া সেই সব মানুষের শীতল দেহগুলি। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল থেকে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল।
ছবি তুলবার জন্য গল্লামারীর অভ্যন্তরে ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে সেদিকে একটি কুকুর খাচ্ছে, আর দূরে অপর একটি লাশের পাশে আর একটি কুকুর বসে হাঁপাচ্ছে। মনে হয় মানুষ খেয়ে তার উদর অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ।
ভাবতে অবাক লাগে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে খ্যাত মানুষকে কুকুরে টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
তথ্য সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র : অষ্টম খন্ড, দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন।