বন্ধ পাটকল পুনরুজ্জীবিত করতে লীজ গ্রহণকারীর দরপত্র আহবান করা হলেও প্লাটিনাম, খালিশপুর ও স্টার জুট মিলের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী কারও সাড়া মেলেনি। ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন, দৌলতপুর, জেজেআই ও কার্পেটিং মিলের জন্য ভারতীয় দুই প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছে। ১৭ জুন ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। গেল বছরের ১ জুলাই থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৫৪ সালে ভৈরব নদের তীরে বেশিরভাগ পাটকল ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠে। এখানকার অধিকাংশ পাটকলের মালিক ছিল পাকিস্তানের আগাখান শিল্প গ্রুপ। ১৯৭২ সালে এসব মিল জাতীয়করণ করা হয়। বিদেশে নতুন বাজার সৃষ্টি না হওয়া, কাঁচা পাটের মূল্য বৃদ্ধি, দিন রাতে অব্যাহত লোডশেডিং এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবে ক্রমাগত লোকসানের কারণে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয় গত ১ জুলাই এখানকার ৭টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে। মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকায় আলীম জুট মিলের ব্যাপারে কোন স্বিদ্ধান্ত নেওয়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মিল বন্ধ ঘোষণা করার পর গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় ৭ মিলের ৩৬ হাজার ৩৯৫ জন শ্রমিকের পাওনা বাবদ নগদ ৭২৯ কোটি টাকা এবং ২৭৩ কোটি টাকার সঞ্চয় পত্র দিয়ে পাওনা পরিশোধ করা হয়।
বন্ধ মিলে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য সরকার পাটকলগুলো ৯৯ বছর মেয়াদে লীজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বন্ধ পাটকলগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হবে। মালিকানা থাকবে সরকারের হাতে। লীজ গ্রহীতারা চালু করতে না পারলে মিলগুলো ফেরত নেওয়া হবে।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুর রউফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্লাটিনাম ও আরও দু’টি পাটকলের জন্য দেশি বিদেশী কারও সাড়া মেলেনি। ক্রিসেন্টসহ অপর মিলগুলো লীজ নিতে ভারতের মোহন জুট ও প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল দরপত্র জমা দিয়েছে। যাচাই বাছাই শেষে শর্ত পূরণ হলে ডিসেম্বরে মিল চালু হবে। ইতোমধ্যে ইনভাইটেশন ফর এক্সপ্রেশন অফ ইনটারেস্ট (ইওআই) স্তর শেষ হয়েছে, চূড়ান্ত কাজ ২০২১ সালের মধ্যেই সমাপ্ত হতে পারে। এরপরই লিজ গ্রহীতাদের হাতে হস্তান্তর করা হবে।
বিজেএমসির খুলনা জোনের মহাব্যবস্থাপক মোঃ গোলাম রব্বানী বলেন, গত অক্টোবরে প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল লীজ গ্রহণের জন্য চীনের একটি প্রতিষ্ঠান এবং ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য জুট মিলের জন্য করিম গ্রুপের প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করেন। পরবর্তিতে তারা পিছিয়ে যায়। মালিকানা নিয়ে বিরোধ হওয়ায় আলীম জুট মিল এর আওতায় আসবে না। বন্ধ মিলের শ্রমিকদের এক হাজার ২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। মিলগুলোর উৎপাদিত সকল প্রকার পাটজাতদ্রব্য বিক্রি হয়ে গেছে।
ক্রিসেন্ট জুট মিলের প্রকল্প প্রধান খান কামরুল ইসলাম জানান, শুধুমাত্র এ জুট মিলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পানি ও কর্মচারির বেতন দিয়ে প্রতি মাসে এক কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তিনি জানান, রূপালী ব্যাংক শামস ভবন শাখায় এ মিলের ধার দেনা চার শো কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, বিজেএমসির মালিকানাধীন জুটমিলগুলোর বার্ষিক কাঁচা পাটের চাহিদা ১৯ লাখ ১১ হাজার মণ। বার্ষিক উৎপাদন হোসিয়ান ৩২ হাজার ৮শ’ মেট্রিকটন, স্যাকিং ৬৫ হাজার ৯৩ মেট্রিকটন ও সিবিসি ৭ হাজার ৮শ’ মেট্রিকটন। যাত্রার শুরুতে মিলের শ্রমিক ছিল ২০ হাজার ৬১৬ জন। বন্ধ থাকার আগ পর্যন্ত ৭ মিলের শ্রমিক ৩৬ হাজার ৩৯৫ জন। তার মধ্যে স্থায়ী ১০ হাজার ৩৬৪ জন ও বদলী শ্রমিক ২১ হাজার ৩৯১ জন। বাকিরা অবসরের শ্রমিক।
পটভূমি
প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল : ১৯৫৪ সালে ভৈরব নদের তীরে গোয়ালপাড়া মৌাজায় স্থাপিত হয়। সাড়ে সাতশ’ তাঁত নিয়ে ১৯৫৮ সালে উৎপাদন শুরু হয়। এর পরিধি ৬৯ দশমিক ৪৪ একর। পাকিস্তানের শিল্পপতি আগা খান গ্রুপের মালিকানায় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম জুটমিলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়।
ক্রিসেন্ট জুট মিল : ১৯৫২ সালে খালিশপুরে মিলটি স্থাপিত হয়। এক হাজার ৩৩ তাঁত নিয়ে ১৯৫৪ সালে উৎপাদন শুরু হয়। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ পাটকলের আয়তন ১১৩ দশমিক ৩ একর। যাত্রার শুরুতেই মালিকানা ছিল পাকিস্তানের শিল্পপতি আগাখান গ্রুপের। স্বাধীনতা পর জাতীয়করণ হয়।
দৌলতপুর জুট মিল : খালিশপুরে ২২ দশমিক ৫৯ একর জমির উপর ১৯৫৪ সালে মিলটি স্থাপিত হয়। আড়াইশ তাঁত নিয়ে ১৯৫৫ সালে উৎপাদন শুরু হয়। লন্ডনের অধিবাসী মাড়োয়ারী এসএল শেঠিয়া যাত্রা শুরুর মালিক। স্বাধীনতার পর মিলটি জাতীয়করণ করা হয়।
খালিশপুর জুট মিল : গোয়ালাপাড়া মৌজায় ৬৩ দশমিক ৬৫ একর জমিতে ১৯৫২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৮শ’ তাঁত নিয়ে ১৯৫৪ সালে উৎপাদন শুরু হয়। প্রথমে মালিকানা ছিল ইপিআইডিসির। ১৯৫৬ সালে আগাখান গ্রুপ মিলটি কিনে নেয়।
স্টার জুটমিল : এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৬ সালে স্থাপিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। শিল্প কারখানাটি ৫৬ দশমিক ৩১ একর জমির ওপর স্থাপিত।
ইস্টার্ণ জুট মিল : মিলটি ১৯৬৭ সালের ১ নভেম্বর স্থাপিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। ৪০ দশমিক ৮৭ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত মিলটি।
কার্পেটিং জুট মিল : এই পাটকলটি যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার রাজঘাটের নোয়াপাড়া শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৬৩ সালে স্থাপিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। ২৩ দশমিক ৬ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।