বঙ্গোপসাগরের গা ঘেষেঁ দাঁড়ানো সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার উপকূলবর্তী উপজেলা দাকোপ। পশুর, চুনকুড়ি ও শিবসা নদী বেষ্টিত এলাকার মানুষরা বারো মাস থাকে সুপেয় পানির সমস্যায়। এলাকার কোন কোন পরিবারে জন্য এক কলস বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে পাড়ি দিতে হয় দুই কিলোমিটার পথ।
পানখালির গৃহিণী তাসলিমা জানান, পানির খুবই সমস্যা। প্রত্যেক বাড়িতে নলকূপ আছে, সব পানিতে আয়রন আছে। থালা বাসন ধোঁয়া ফেলা করলে কিছু দিন পর লাল আবরণ পড়ে যায়। এ পানি আমরা পান করতে পারি না। মাটি থেকে এত বেশি লবন ওঠে যে ছোট,বড়ো সব পুকুরের পানিও নষ্ট হয়ে গেছে। মিষ্টি পানি পায়ে হেঁটে হোগলাবুনিয়া থেকে নিয়ে আসি। দু’কলস পানি আনতে পাড়ি দিতে হয় দুই কিলোমিটার পথ।
একই গ্রামের জিয়াউল সরদার জানান, অনেকবার গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে মিষ্টি পানি পাওয়া যায়নি। পানি টক ও আয়রন রয়েছে। বাসন মাজা, গোসল ও শৌচাগারে ছাড়া অন্য কিছু করা যায় না। খাবার পানির জন্য আমরা প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করি। যাদের ট্যাংক আছে তারা দু’চার মাস পানি ধরে সংরক্ষণ করে পান করে। আর যাদের বড় পরিবার তাদের পানির সংকট অনেক বেশি।
২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে দেশের উপকূলীয় মানুষের নিরাপদ খাওয়ার পানির দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। উপকূলীয় পাঁচ উপজেলার ৭৩ শতাংশ মানুষকে অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। জরিপে, উপকূলীয় পাঁচ উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাওয়ার পানিতে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা রয়েছে। প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা খাওয়ার অনুপযোগী বলে গণ্য করা হয়। এলাকাবাসী পানি সংগ্রহ করে এ রকম ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।জরিপে গড়ে দাকোপ উপজেলার পুকুরগুলোতে ৬৫০ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ২৪ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫৮১ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ১ হাজার ২০৩ মিলিগ্রাম এবং শ্যামনগরে ১ হাজার ১৮৪ মিলিগ্রাম লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া টিউবওয়েলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা রয়েছে দাকোপে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ৪৫৩ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫১০ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ৯৯৮ মিলিগ্রাম ও শ্যামনগরে ১ হাজার ৬৮৩ মিলিগ্রাম।এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বা শীতকালে শ্যামনগর উপজেলার টিউবওয়েলের প্রতি লিটার পানিতে ৬ হাজার ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে, যা অনুমোদিত সীমার ছয় গুণের বেশি।পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নে ৬৬ হাজার ২৩৪টি পরিবারের ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৪ জনের মধ্যে ওপর ‘জেন্ডার-রেসপন্সিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)’ শীর্ষক এ জরিপ চালানো হয়। জরিপে বলা হয়, অনেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন। কখনও কখনও গভীর নলকূপ বা পুকুর থেকে পানি আনতে তাদের এক কিলোমিটারের বেশি হাঁটতে হয়। ৬৩ শতাংশ মানুষ সেই পানি পেতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। কারণ তাদের খাওয়ার পানির অন্য কোনো উৎস্য নেই।
এ সমস্যার সমাধানে বিষয়ে সেন্টার ফর এনভায়নমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এর চেয়ারম্যান গৌরাঙ্গ নন্দীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুন্দরবন উপকূল অঞ্চলে বসতির শুরু থেকে সুপেয় পানি সংকট ছিল। কারণ উপকূল অঞ্চল মানে ব্ল্যাক ইস ওয়াটার জন। মানুষ বসতির শুরুতে লৌকিক জ্ঞান এর মাধ্যমে তাদের পানির সমস্যার সমাধান করতেন। বিষয়টি ছিল পুকুরের পানির ও সংরক্ষণ করা। ৮০দশকের দিকে মানুষ লোনা পানি টেনে শুরু করে চিংড়ি চাষ। ক্রমশ কমতে থাকে মিষ্টি পানি আধার। শুরু হয় সুপেয় পানির সংকট। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে পুরানো পদ্ধতিতে বড় করে পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে। পুকুরের পাড় চওড়া ও মজবুত করে তৈরি করতে হবে যাতে করে লবণ পানি ঢুকতে না পারে । এ অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সুপেয় পানির সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না।
খুলনার জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মঈনুল হাসান বলেন, উপকূল অঞ্চলের এই পাঁচ জেলায় গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব না। তাদের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
খুলনা গেজেট/ টিএ