খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ পৌষ, ১৪৩১ | ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  খুলনা-ঢাকা রুটে নতুন ট্রেন ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ চলাচল শুরু

বিএনপির মামলার জালে নিরীহ ব্যক্তিরা : নেপথ্যে স্থানীয় দ্বন্দ, চাঁদাবাজি ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ!

নিজস্ব প্রতিবেদক

case

খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার আয়তুুন্নেসা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মারুফাতুল মতিন। ভালো শিক্ষিকা হিসেবে এলাকার সবার সম্মানের পাত্র তিনি। গত ২৯ আগস্ট দিঘলিয়া থানায় বিএনপি নেতার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৬১ নম্বর আসামি করা হয়েছে তাকে।

আবার খুলনার স্বনামধন্য ব্যবসায়িক গোষ্ঠী হ্যামকো গ্রুপের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে গত ৩০ আগস্ট নগরীর খালিশপুর থানা বিএনপির কার্যালয় ভাংচুরের মামলায়। অথচ পরিবারটির কেউই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন।

একই মামলায় আসামি হয়েছেন খুলনা চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফ আতিয়ার রহমান ও পরিচালক শাহ আলম তুহিনকে। নির্দলীয় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে খুলনায় সুনাম রয়েছে তাদের।

শুধু এই দুটিই নয়; আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে  বিএনপি নেতাদের দায়ের করা মামলাগুলোতে নিরীহ ব্যক্তি, ব্যবসায়ীকে আসামি করা হচ্ছে।

প্রতিটি মামলার বাদি বিএনপির স্থানীয় নেতারা। তাদের অধিকাংশই আসামিদের চেনেন না বা নাম জানেন না। মামলার এজাহার তৈরি করে দিচ্ছেন মহানগর ও থানা কমিটির দু’একজন নেতা।

এ সব মামলার পেছনে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অন্য ব্যবসায়ীদের মাঝে ভীতি ছড়ানো, চাঁদা দিতে অস্বীকার করা এবং পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ¦ও ভূমিকা রাখছে। এনিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে সব মহলে।

গত ২৯ আগস্ট দিঘলিয়া থানায় দায়ের করা মামলার বাদি জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোল্লা খায়রুল ইসলাম। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট বিএনপির একটি কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে তাকে দিঘলিয়ায় তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। মামলায় ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ২০/২৫ জনকে আসামি করেন তিনি।

আসামিদের মধ্যে ৭৪ নম্বরে রয়েছে আয়তুুন্নেসা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এস এম আবু সাঈদ। তিনিও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন।

প্রধান শিক্ষিকা মারুফাতুল মতিন বলেন, চাকরি জীবনে তো নয়ই, ছাত্র জীবনেও কখনো রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। কেন আসামি করা হলো বুঝতে পারছি না।

শিক্ষকরা কেন আসামি?-জানতে চাইলে বাদি মোল্লা খায়রুল ইসলাম বলেন, হামলার সময় কোনো নারী উপস্থিত ছিলেন না। মামলার বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুর রহমান মিন্টুর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানান।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মিন্টু মোল্লার স্ত্রী শামসুন্নাহার ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকা এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকের দ্বন্দ্ব আছে। এর জের ধরে দুই শিক্ষককে আসামি করা হয়েছে।

তবে সাইফুর রহমান মিন্টু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষিকা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সাবেক এমপি সালাম মূর্শেদী দিঘলিয়া আসলে তারা সেখানে ছুটে যেতেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

৩০ আগস্ট খালিশপুর থানায় দায়ের করা মামলার বাদি মহানগর বিএনপির সদস্য শাহিনুল ইসলাম পাখি। এজাহারে গত ৪ আগস্ট বিকালে খালিশপুর থানা বিএনপি কার্যালয় ভাংচুর, ড্রয়ার থেকে ১২ হাজার টাকাসহ লাইট, ভ্যান, টিভিসহ বিভিন্ন জিনিস লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়। মামলায় ১৮০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় ৬০/৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এই মামলায় শিল্পপতি আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে ৩ নম্বর, চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফ আতিয়ার রহমানকে ১২৪ নম্বর এবং চেম্বারের পরিচালক শাহ আলম তুহিনকে ১৩৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

মামলার বিষয়ে বাদি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হ্যামকো গ্রুপের প্যাকেজিং কারখানা নগরীর খালিশপুর চরের হাটে অবস্থিত। কারখানার উচ্ছৃষ্টাংশের ব্যবসা ছিল ১৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোরশেদ আহমেদ মনি’র নিয়ন্ত্রণে। চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি পেতে ১৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুন্নার স্বরণাপন্ন হতেন তারা। ৫ আগস্টের পর উচ্ছৃষ্টাংশের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর বিএনপির কয়েকটি গ্রুপ। মোটা অংকের চাঁদা দাবিরও ঘটনা ঘটেছে।

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দেশের বাইরে রয়েছেন। তার পক্ষে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, খুলনাসহ সারাদেশের মানুষ হ্যামকো গ্রুপের পরিচালকদের সম্পর্কে জানেন। তারা কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। গত ২০/২৫ দিনে অনেক ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।

শরীফ আতিয়ার রহমান খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি। ব্যবসায়ীদের বেশকিছু সংগঠন, মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রধান তিনি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী আমিনুল হকের নেতৃত্বাধীন চেম্বার অব কমার্সে যোগ দেন। কাজী আমিন বিদেশে থাকায় বর্তমানে তিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। সম্প্রতি চেম্বারের দখল নিতে নানা তৎপরতা শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা।

খুলনা-বরিশালসহ এ অঞ্চলে নৌপরিবহন ব্যবসায় পরিচিত মুখ শাহ আলম তুহিন। চেম্বার অব কমার্স ছাড়াও তিনি অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন মালিক গ্রুপের পরিচালক। সম্প্রতি গ্রুপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি যাতে নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে না পারেন এবং অন্য ব্যবসায়ীদের মাঝে ভীতি ছড়ানোর জন্য তাকে আসামি করা হয়েছে-বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা।

শাহ আলম তুহিন বলেন, কখনো রাজনীতি করিনি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জন্য ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। এর চেয়ে বেশি কিছু না।

শরীফ আতিয়ার রহমান বলেন, গত ১৫ বছরে একধরনের চাপে ব্যবসা করেছি, এখন আরও পরিস্থিতি আতংকজনক।

এ বিষয়ে খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, যারা আওয়ামী লীগ করে এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে।

খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, এতো রক্ত, এতো মৃত্যুর পরও রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের উচিত নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানী না হয় তার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

মামলার বিষয়ে খালিশপুর থানার ওসি (তদন্ত) আশীষ কুমার মিত্র বলেন, নিরীহ কেউ থাকলে তদন্তে অবশ্যই তার নাম বাদ যাবে।

সূত্র : সমকাল

খুলনা গেজেট/হিমালয়/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!