খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

খুলনায় পানি মিলছে না নলকূপ-মোটরে, নিচে নামছে ভূগর্ভের স্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুলনা নগরীর শেখপাড়া এলাকায় নিজের চারতলা ভবন রয়েছে সিরাজুল ইসলামের। ভবনটিতে রয়েছে নলকূপ ও মোটর দিয়ে পানি তোলার ব্যবস্থা। কিন্তু এ মাসের প্রথম থেকে নলকূপ ও মোটর কোনোটিতেই পানি উঠছে না। ওয়াসার পাইপ লাইনের পানি দিয়ে অন্যান্য প্রয়োজন মিটছে। কিন্তু খাবার ও রান্নার পানির জন্য তাকে ছুটতে হচ্ছে প্রতিবেশীর বাড়িতে।

সিরাজুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘নিজের বাড়ি, কল থাকতেও খাওয়ার পানির জন্য পাশের বাড়ি যাচ্ছি। পানির এই কষ্ট কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। দিনের বেলায় সবার সামনে পানি টানতে লজ্জা লাগে, তাই রাতে পানি আনি।’

নগরীর মৌলভীপাড়া টি বি বাউন্ডারি রোডে মডার্ন টাওয়ারের সামনে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে পানি নিতে যান অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষ। ওই ভবনের সিকিউরিটি গার্ড মো. বাবুল জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টা এবং বিকেল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে লোকজনকে বিনামূল্যে পানি দেয়া হয়। আশপাশের অনেক বাড়ির নলকূপ ও পাম্পে পানি না ওঠায় তারা এখান থেকে পানি নিয়ে যান।

ওই সড়কের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না। সে কারণে প্রতিদিন সকালে বোতল ও জার নিয়ে এখানে পানি নিতে আসি। শুধু এই দুইজনই নয়, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে খুলনা নগরীর বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষের কষ্টের আরেক নাম এখন খাবার পানি।

চলতি মাসের প্রথম থেকে নগরীর অধিকাংশ স্থানের অগভীর নলকূপে পানি উঠছে না। গভীর নলকূপের সঙ্গে যাদের পাম্প রয়েছে সেগুলোতেও পানি উঠার পরিমাণ কমে গেছে। ঠিকমতো পানি উঠছে শুধু গভীর নলকূপের সঙ্গে থাকা সাবমার্সিবল পাম্পে। তবে তা স্থাপন ব্যয়বহুল হওয়ায় সবাই বসাতে পারছে না। অন্যদিকে, খুলনা ওয়াসা পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করলেও তা পানের উপযোগী নয়। ফলে উচ্চবিত্ত প্রতিবেশীর বাড়ির সাবমার্সিবল পাম্পই এখন খাবার পানির একমাত্র ভরসা।

সংকটের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীতে দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিতভাবে গভীর-অগভীর নলকূপ, সাধারণ পাম্প ও সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। প্রতিদিন ভূ-গর্ভ থেকে ৫ কোটি লিটারের বেশি পানি না তুলতে পরামর্শ দিয়েছিল এডিবি। কিন্তু পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এর ফলে ক্রমাগত নিচে নেমে গেছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। গত ৯ বছরের ব্যবধানে নগরীর ১৪টি ওয়ার্ডে পানির স্তর নিচে নেমেছে ১ দশমিক ৯৮ মিটার থেকে ৪ দশমিক ০৪ মিটার (১৩ দশমিক ২৫ ফুট) পর্যন্ত। এর ফলে চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি উঠছে না অনেক নলকূপ ও পাম্পে।

ওয়াসা প্রতি বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালায়। সংস্থাটির জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের তুলনায় নগরীর ৯, ১০, ১২, ১৪, ১৬, ১৮, ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে ১ দশমিক ৯৮ মিটার থেকে ৪ দশমিক ০৪ মিটার পর্যন্ত।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নগরীর শেখপাড়া, গোবরচাকা, বড় মির্জাপুর, ছোট মির্জাপুর, বাইতিপাড়া, টুটপাড়াসহ আরও অনেক এলাকার বাড়ির অগভীর নলকূপ থেকে একেবারেই পানি উঠছে না। আগে সড়কের পাশে ছোট মির্জাপুর এলাকায় দুটি, বড় মির্জাপুর এলাকায় দুটি, বাইতিপাড়া এলাকায় দুটি, দেবেন বাবু রোড ও টিবি বাউন্ডারি রোডে একটি নলকূপ ছিল। পানি না ওঠায় সেগুলো খুলে ফেলা হয়েছে। নগরীর জিন্নাহপাড়া এলাকার বাসিন্দা জাকারিয়া হোসেন তুষার বলেন, বাড়ির গভীর নলকূপে চলতি মাসে আর আগের মতো পানি উঠছে না। কল চাপতে চাপতে হাত ব্যথা হয়ে যায়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, নগরী এবং সংলগ্ন এলাকাগুলোতে জলাশয় এবং বৃষ্টিপাতের সময়সীমা ও পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়া ভূ-গর্ভ থেকে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, তার সমপরিমাণ পানি ভূ-গর্ভস্থ স্তরে জমা হচ্ছে না। এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে এবং প্রতি বছরই পানি সংকট বাড়ছে।

এ ব্যাপারে খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ বলেন, ভূ-গর্ভস্থ ১ হাজার লিটার পানি তুলে সরবরাহ করতে তাদের ব্যয় হয় ১১ টাকা। আর মধুমতি নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহে ব্যয় হয় সাড়ে ১৭ টাকা। তবে এখনো ব্যয় কমাতে ভূ-গর্ভের পানি তোলা পুরোপুরি বন্ধ করেনি তারা। অন্যদিকে, গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ১ হাজার লিটার পানির মূল্য নেন ৯ টাকা।

তিনি বলেন, যদি মধুমতি নদীর আরও বেশি পরিমাণ পানি তারা পরিশোধন করেন তাহলে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। তখন তাদের ভর্তুকিও বেশি দিতে হবে। তাছাড়া এই মুহূর্তে তারা গ্রাহকের ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপাতে চাইছেন না। সে কারণে ভূ-গর্ভ থেকে পানি তোলা বন্ধ করা হয়নি।

এত বেশি ব্যক্তিগত নলকূপ ও সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার ৮০০। কিন্তু এখনো প্রায় ২০ শতাংশ পরিবার ওয়াসার পানির সংযোগ গ্রহণ করেনি। তারা নলকূপ ও পাম্প দিয়ে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করেন।

 

খুলনা গেজেট/হিমালয়




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!