খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

খুলনাবাসি স্বজন হারানোর বেদনায় আপ্লুত

কাজী মোতাহার রহমান

ষোল আগস্ট, ১৯৭৫। খুলনার আকাশ ছিল স্বজন হারানোর বেদনায় আপ্লুত। সেদিন খুলনার আকাশে ওড়েনি পাখি, গাছের একটি পাতাও সেদিন নড়েনি বাতাসে। ভৈরব নদ ও রূপসা নদীতে চলেনি নৌকা। বেতারে খুনিদের ঘোষণা শুনে নির্বাক মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। চারিদিকে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে কানাকানি। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বশেষ খবর কি?

প্রত্যক্ষদর্শী খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি (২০০৭) চিশতী সোহরাব হোসেন শিকদার। তিনি গোপালগঞ্জ মহাকুমার বনগ্রামের মৃত আব্দুল মজিদ শিকদারের পুত্র। ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী বিএ হেমায়েত মোল্লার প্রতিবেশী। ১৯৪৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার জানাশোনা। লোকমুখে ১৫ আগস্টের খবর জানার পর তিনি টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। দিনটি ছিলো ঠিক তার পরের দিন। খুলনা-বরিশাল রুটের একটি নৌযানে উঠে মোল্লাহাট ও কালিয়া সংযোগস্থলে নামেন। এখানকার পল্লীতেও নিরবতা। কিছুটা পায়ে হেঁটে আবার নৌকাযোগে পাটগাতি দিয়ে বনড়বী হয়ে বনগ্রামে পৌঁছান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জানাযা ও দাফনের বর্ণনা করে বলেন, ষোল আগস্ট ছিল শনিবার। অবশেষে সকাল সাড়ে আটটায় জানা গেল টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ ঢাকা থেকে দুপুর নাগাদ আসবে। তাঁকে টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হবে। এই খবর ঢাকার পুলিশ সুপার আবদুস সালাম জানিয়েছিলেন গোপালগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা মোঃ নূরুল আলমকে। নূরুল আলম আবার টেলিফোনে জানিয়েছিলেন টুঙ্গীপাড়ার ওসি শেখ আবদুল জলীলকে। ঢাকা থেকে পুনর্বার এসডিও বদিউর রহমান ফোনে নূরুল আলমকে একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে টুঙ্গীপাড়া যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং সেখানে কবর খননসহ কবরস্থান ও হেলিপ্যাডের নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বলেন।

পুলিশ কর্মকর্তা নূরুল আলম অল্প সময়ের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, সিআইডি আবদুর রহমান, পুলিশ পরিদর্শক ইসহাক ফকির ও ড্রাইভার আব্দুর রহমানসহ মোট সাত জনকে নিয়ে স্পীডবোটে গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গীপাড়া থানায় আসেন এবং ডাকবাংলার কাছে হেলিপ্যাডের অবতরণ স্থান পরিদর্শন করেন। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইনের পুলিশ, বাঁশবাড়িয়ার পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ ও স্থানীয় থানার পুলিশরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ী ও কবরস্থানের নিরাপত্তা জোরদার করে।

স্থানীয় হাসপাতালের ক’জন কর্মচারী ছাড়া সেদিন টুঙ্গীপাড়া ছিল জনমানবশূন্য। টুঙ্গীপাড়ার আকাশ কাঁপিয়ে একটি হেলিকপ্টার হেলিপ্যাডের মাটি থেকে ত্রিশ হাত ওপরে স্থির হয়। এ সময় একজন আর্মি অফিসার স্থানীয় অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন। মহাকুমা পুলিশ কর্মকর্তা নূরুল আলম তাঁকে সবকিছু অবহিত করেন। লাশ বহনকারী হেলিকপ্টারের সেনা কর্মকর্তা মেজর মহিউদ্দীন প্রথম থেকেই ধমকের সুরে কথা বলেন।

এ সম্পর্কে পুলিশ কর্মকর্তা নূরুল আলম ‘যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেই বঙ্গবন্ধুকে নিজের হাতে মাটি দিয়েছি’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘আমি ডাকবাংলার বারান্দা থেকে হেলিপ্যাডে গেলাম। নিজেকে মহাকুমার পুলিশ অফিসার বলে পরিচয় দিলাম। তিনি এলাকার নিরাপত্তার জন্য কত ফোর্স নিয়োজিত আছে জানতে চাইলেন। আমি বললাম, থানা ও ক্যাম্পের ফোর্সদেরকে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ থেকে আরো ফোর্স আসছে। ফোর্স আসতে এত দেরির কৈফিয়ত চাইলে জানালাম, মধুমতি নদী হয়ে লঞ্চ নিয়ে ফোর্স আসছে।

আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ বাওড়ের মধ্যে দিয়ে স্পীডবোটে এসেছি। নিরাপত্তার কোনো অসুবিধা হবে না জানানোর পর হেলিকপ্টার নামল। সাথে সাথে দরজা খুলে কয়েকজন সৈনিক হেলিকপ্টার ও ডাকবাংলার চারদিকে দ্রুতগতিতে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করল। দু’জন আর্মি অফিসার (মেজর হায়দার-সিগন্যাল কোর এবং মেজর মহিউদ্দিন-অর্ডিন্যান্স কোর পরে নাম জানা গেছে) নেমে এসে ধমক দিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘এখানে এত সিভিল লোক কেন?’ অপেক্ষামান ম্যাজিস্ট্রেট ও ব্যাংক কর্মচারীদের পরিচয় দিলে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘লাশ ছিনতাই বা কবর থেকে লাশ উঠিয়ে নেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তো?’ নিরাপত্তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিলে হেলিকপ্টার থেকে লাশ তাড়াতাড়ি নামিয়ে কবরস্থানে নেয়ার হুকুম দেয় তারা।

কফিন নামানোর জন্য হেলিকপ্টারের পিছন দিকে উঠলাম। সার্কেল ইন্সপেক্টর ও দু’জন কনস্টেবল নিয়ে কফিন নামাতে ব্যর্থ হলে কর্মচারীদের সাহায্য নিতে হল। উপস্থিত আর্মির হাবিলদার হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামাতে সাহায্য করে। বহু কষ্টে কফিনটি ডাকবাংলার সামনে আনি। ওই ক’জন লোকের পক্ষে বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। বরফ ভর্তি কফিনের ওজন ছিল অত্যন্ত বেশি। তখন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো থানার ওসিকে নিয়ে টুঙ্গীপাড়া হাসপাতালের পিছনে লোক খুঁজতে যাই। লোক না পেয়ে ওসিকে লোক সংগ্রহ করার নির্দেশ দিয়ে তাড়াতাড়ি কফিনের কাছে ফিরে আসি।

আমার সাথে আসা স্পীডবোট ড্রাইভার, কনস্টেবলদ্বয় কর্মচারীদের সাহায্যে কফিনটি নিতে থাকি। কিছুদূর যাওয়ার পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে আসা চার-পাঁচজন গ্রামবাসী কফিন বহনে যোগ দেন। দশ-বারোজন লোক কফিন কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দিকে এগোতে থাকি। ওসিকে জানাজার জন্য ইমাম ডাকতে বলি। তিনি ইমাম ডাকার জন্য হাসপাতালের দিকে যান। আমরা লাশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর উঠোনে রাখি। সেখানে কবর খননকারী চার-পাঁচজন লোক অপেক্ষায় ছিল। এলাকায় বা বাড়ীর আশপাশে কোনো লোকজন ছিল না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর বহুদিনের পুরোনো সরকার বৈকুণ্ঠ লাশ আনার খবর পেয়ে পালিয়েছিল।

বাড়ীতে আসার পর আর্মি অফিসারদের একজন বললেন, ‘শেখ সাহেবের কোনো আত্মীয় আছে কি না, ডাকেন। আমরা তাঁর নিকট লাশ বুঝিয়ে দেব।’ বাড়ীর ভেতর লোক পাঠানো হলো। উপস্থিত লোকজনের সাহায্যে কফিন খোলা হলো। সাদা কাপড় মোড়ানো বঙ্গবন্ধুর লাশ কফিন থেকে বের করে ডালার ওপর রাখা হলো। পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় সাদা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশ কফিনের ভেতর রাখা ছিল। কাফনের কাপড় আনার জন্য পাটগাতী বাজারে লোক পাঠাতে চাইলাম।

মেজর বললেন, ‘বাজার থেকে কাপড় আনতে দেরি হবে। গোসল জানাজা সেরে যে কাপড় আছে সেটা দিয়েই দাফন করার ব্যবস্থা করুন।’ দ্রুত গোসলের ব্যবস্থা করতে যেয়ে বাড়ীর টিউবওয়েল থেকে পানি আনার জন্য সেখানে রক্ষিত গরুর খইল/ভুসি খাওয়ার বালতি ব্যবহার করতে হলো। পরনের পাঞ্জাবী ও গেঞ্জি খুলতে অসুবিধার সৃষ্টি হলে চাকু অথবা ব্লেডের ব্যবস্থা করা যায় কি না জানতে চাই। কে যেন বলল পাশের দোকানে ব্লেড পাওয়া যেতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন দোকান থেকে একটি ব্লেড ও একটি ৫৭০ (কাপড় কাচার) সাবান নিয়ে আসলেন।

এ সময় ওসি, মৌলভী আব্দুল হালিম ও আরো দু’জন লোক নিয়ে উপস্থিত হলেন। অতঃপর মৌলভী সাহেবকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী লাশ গোসল দিতে বললে উপস্থিত সকলেই ইতস্তত করতে থাকেন। খোলা উঠোনে কিসের ওপর রেখে গোসল হবে! একজন গিয়ে গরুর ঘরের পাশ থেকে হোগলা-চাটাই অথবা বেড়া জাতীয় কিছু একটা আনল। তা দিয়েই লাশকে একদিকে আড়াল করা হলো। পরনের পাঞ্জাবী ও গেঞ্জি ব্লেড দিয়ে কেটে শরীর থেকে বের করলেন মৌলভী সাহেব। তিনি আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। তাই হাত কাঁপছিল। শেষে আমি ব্লেড দিয়ে পরনের পাঞ্জাবী-গেঞ্জি বুক ও পেটের ওপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে কেটে দেই। গোসল হলো। লাশ মুড়িয়ে আনা ভেজা রক্তাক্ত সাদা কাপড়টিকে কীভাবে কাফনের কাপড় হিসেবে তৈরি করা যায় তার চেষ্টা চলল।

এ সময় সিআইডি শেখ আব্দুর রহমান এসে বললেন, স্থানীয় রেডক্রস হাসপাতালে রিলিফ দেয়ার জন্য কিছু সাদা শাড়ি আছে। ভেজা কাপড়ের চেয়ে ওই কাপড় দিয়ে কাফন তৈরি করা সহজ হবে। তখন আমি শাড়ি আনতে বলি। কিছুক্ষণ পরে তিন-চারটি শাড়ি আনা হলো। ব্লেড দিয়ে শাড়ির কাপড় কেটে বঙ্গবন্ধুর শরীরের মাপে কাফন তৈরি করে লাশকে পরিয়ে দেয়া হলো। এবার জানাজার প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে পরিদর্শক ইসহাক ফকির যিনি কবরস্থান এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি জানালেন আশপাশের কিছু লোক জানাজায় শরিক হতে চায়। এ ব্যাপারে মেজরকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি রেগে যান। নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ নেই কেন, অভিযোগে আমাকে ভৎর্সনা করে বললেন, ‘বেশি লোক জমায়েত হলে লাশ ছিনতাই হবে। তাড়াতাড়ি কবর দিন।

এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতী চাচা পরিচয়ে আসা শেখ আবদুল মান্নান ওরফে পনু মিয়ার নিকট মেজর লিখিতভাবে লাশ হস্তান্তর করেন। ওই কাগজে সাক্ষী হিসেবে থানার ওসি ও আমার এবং ম্যজিস্ট্রেট আবদুল কাদের-এর স্বাক্ষর নিয়েছেন। তারপর সকলে মিলে মরদেহের ডালাটা ধরাধরি করে কবরের পাশে নিয়ে যাই। মৌলভী সাহেবকে জানাজা পড়ানোর জন্য বলি। উপস্থিত চব্বিশ-পঁচিশজন লোক, পুলিশ অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেটসহ দু’কাতারে জানাজার জন্য দাঁড়াই। ইমাম সাহেব তিন কাতার করতে বলেন। এই প্রেক্ষিতে আমি নিজে আরো কয়েকজনসহ তৃতীয় কাতারে দাঁড়িয়ে জানাজা আদায় করি।

তারপর লাশ কবরে শুইয়ে দেয়া হয়, এ সময় এক মহিলা অত্যন্ত উচ্চস্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দালানের পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন লাশ দেখার জন। ঠিক এই সময় ফরিদপুরের এএসপি (সদর) আনোয়ারুল ইকবাল উপস্থিত হন। তিনিও লাশ দেখার ইচ্ছা পোষণ করেন। তখন কবরে শোয়ানো অবস্থায় লাশের মুখ খুলে তাকে এবং ক্রন্দনরতা মহিলাকে দেখানো হয়। তারপর তাড়াহুড়ো করে মাটি দিয়ে সেই কবরের নিরাপত্তার দায়িত্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ওপর রেখে আমরা আবার হেলিপ্যাডের দিকে রওনা হই। হেলিকপ্টারের ককপিটে অবস্থানরত পাইলট আমাদের দেখে হেলিকপ্টারের সুইচ অন করেন। আর্মিরা সকলে হেলিকপ্টারে আরোহনের পর দ্রুত হেলিকপ্টার টুঙ্গীপাড়া ত্যাগ করে।’

টুঙ্গীপাড়ার মা-বাবার কবরের পাশে বঙ্গবন্ধুকে ১৬ আগস্ট সমাধিস্থ করার ঘটনা অনেকের কাছে অজানা। আমরা অনেকে জানি না, সেদিন খুনিদের ভয়-ডর-উপেক্ষা করে প্রাণের টানে হেলিপ্যাড থেকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ কাঁধে করে নিয়ে আসেন- আবদুল হাই, নজীর মোল্লা, ইলিয়াস সরদার, তোতা মিয়া, তোতা মিয়ার বাবা জর্জিসা মুনশী, ইদ্রিস কাজী, শেখ রজব আলী, আতিয়ার কাজী ও বাবর শেখ। বঙ্গবন্ধুর কবর খোড়েন- মান্নান শেখ, সোহরাব শেখ, ইমান গাজী, রজব আলী, এনায়েত মিয়াসহ আরও ক’জন। বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত দেহ যারা গোসল করান তারা হলেন- আব্দুল হালিম মৌলভী, আবদুল মান্নান শেখ, শেখ নূরুল হক, গেদু মিয়া, কেরামত হাজী ও ইমান গাজী।

বঙ্গবন্ধুর দেহ যারা নামান- আবদুল মান্নান শেখ, কাশেম হাজী, নজীর মোল্লা ও ইমান গাজী। কফিনের ঢাকনা খোলেন- আইউব আলী ও তার বাবা হালিম মিস্ত্রী। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে নার্স দীপালীর মাধ্যমে কাফনের কাপড় (রিলিফের শাড়ি) যোগাড় করেন আবদুল হাই শেখ। ৫৭০ সাবান দোকান থেকে সংগ্রহ করেন কাজী ইদ্রিস। লোকমান শেখের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটেন সোহরাব শেখ। পুকুর ও টিউবওয়েল থেকে পানি এনে দেন হিরু শেখ। গোসল করানোর কাজে অংশ নেন কেরামত আলী হাজী। বঙ্গবন্ধুর কাফন তৈরি ও জানাজা পড়ান আবদুল হালিম মৌলভী। বঙ্গবন্ধুর কাফন ও দাফনের কাজে অংশ নিয়েছিলেন এসব ব্যক্তিরা। অনেকেই ইতোমধ্যে মৃতুবরণ করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে সমাধিস্থ করে ধন্য হয়েছিলেন।

ষোল আগস্ট ৭৫’র পর ৩ মাস ধরে তাঁর কবরের কাছে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সহচর কোটালীপাড়ার শেখ সেকেন্দার আলী টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে গিয়ে অবস্থান করেন। একসময় তিনি বঙ্গবন্ধুর শোকে পাগল হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে এঁটে তিনি জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু একটি অনুরোধ করেছিলেন। অনুরোধটি ছিল, “আমি মরে গেলে তোরা আমাকে টুঙ্গীপাড়ায় কবর দিবি। আমার কবরের ওপর একটি টিনের চোঙা লাগিয়ে দিবি।” একজন তাকে প্রশ্ন করেছিল, টুঙ্গীপাড়ায় আপনার কবরের কথাটি না হয় বুঝলাম, টুঙ্গীপাড়া আপনার জন্মস্থান। কিন্তু এই চোঙা লাগানোর ব্যাপারটি তো বুঝলাম না। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘টুঙ্গীপাড়ায় শুয়ে আমি পাখির ডাক শুনব, ধানের সোঁদা গন্ধ পাব।’ আর চোঙা লাগাতে বলেছি এ জন্য যে, এই চোঙা ফুঁকে একদিন শেখ মুজিব নামের এক কিশোর বাঙালি-বাঙালি বলতে বলতে রাজনীতি শুরু করেছিল।

বঙ্গবন্ধু নিজেকে জানতেন, বাঙালিকেও চিনতেন, শৈশব থেকে শুরু করে আজীবন তিনি এই বাঙালির জন্য রাজনীতিই করেছেন। শৈশবে বাবা-মা’র আদরের খোকা এই বাঙালি জন্য রাজনীতি করতে-করতেই একদিন হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, শেখ সাহেব এবং মুজিব ভাই। তারপর সময় গড়িয়ে ঊনসত্তুরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালির দেয়া অভিধায় হলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর ঘটে গেল বাঙালির জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন। বাঙালি জাতি ও রাষ্ট্রীয় সত্ত্বায় ভূষিত হন, যার অনুঘটক হলেন এই বঙ্গবন্ধু। কাজেই তিনি আর শুধু বঙ্গবন্ধু রইলেন না। হয়ে উঠলেন জাতির পিতা। বাঙালি জাতির নির্মাণ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল, কিন্তু এই জাতির রাষ্ট্রীয় পরিচয় প্রাপ্তির জটিল ও কঠিন পরিক্রমায় অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ব্যক্তি শেখ মুজিব হারিয়ে গেলেও জনতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চরঞ্জীব।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!