জুতা, ব্যাগ ও পোশাকসহ চামড়াজাত জিনিসের কদর বিশ্বজুড়ে। তবে কদর নেই কাঁচা চামড়ার। রেকর্ড পরিমাণ দরপতনে সারাদেশের ন্যায় খুলনা অঞ্চলেও এবারের কোরবানীর চামড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। বিভাগীয় শহর খুলনায় যাতয়াত খরচের অর্ধেক দামে চামড়া বিক্রি করে হতাশ হচ্ছেন বিক্রেতারা।
মৌসুমী ব্যবসায়ী মোসলেম উদ্দিন বলেন, গত দুই/তিনবার চামড়া কিনে ঠকেছি। এবার সবচেয়ে ভালো ও বড় মাপের চামড়া ১০০ থেকে ২৫০ টাকায় কিনেছি; তাতে লোকসান হতে পারে এবারও।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের মতোই এবারও চামড়ার কদর নেই। এ কারণে পাড়া-মহল্লা থেকে খুবই অল্প দামে চামড়া সংগ্রহ করেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ছোট গরুর চামড়া কেনেননি কেউ। ছাগলের চামড়া কেনাবেচা করতে দেয়া যায়নি। আবার চামড়া বিক্রি করতে এসে পথ খরচও উঠেনি কোরবানীদাতাদের। পুঁজি হারিয়ে ও পশুর চামড়ার দরপতনে খুলনা শেখপাড়ায় চামড়ার আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এবার ঈদে আগের মতো আয়োজন করে পশুর চামড়া কিনতে দেখা যায়নি। অর্ধশতাকি ব্যবসায়ীর এ প্রাণোচ্ছ্বল চামড়া পট্টিতে এবার চামড়া কিনেছেন মাত্র ৬জন ব্যবসায়ী। তারা শের-ই বাংলা রোডে উপরে চামড়ায় লবন দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
নগরীর খালিশপুরের বাসিন্দা আবদুস সোবাহান নিজের কোরবানি করা গরুর চামড়া ইজিবাইকে করে নিয়ে এসেছিলেন শের-ই বাংলা রোডের শেখপাড়া চামড়া পট্টিতে বিক্রি করতে। ৫০ টাকায় ইজিবাইক ভাড়া করে এসে সেই চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ৫০ টাকায়। ফলে ৫০ টাকার চামড়া বিক্রিতে যাওয়া ও আসায় তাঁর খরচ হয়েছে ১০০টাকা।
খুলনা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম ঢালী বলেন, ‘ট্যানারি মালিকরা পাওয়া অর্থ না দেয়ায় পুঁজি সংকটে খুলনার ৮০শতাংশ ব্যবসায়ী একটি চামড়াও কিনেননি। মাত্র ছয়জন ব্যবসায়ী প্রায় দশ হাজার পিচ চামড়া কিনেছি। বহু চামড়া ফেরত দিয়েছি,কিনিনি। খুলনার চামড়াগুলো ফুলতলা, নওয়াপাড়া, যশোর, নাটোর, ঢাকা অঞ্চলে বিক্রি করে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার ৫০, ৬০, ৭০ হাজার টাকামূল্যের গরুর চামড়া আমরা কিনিনি। এক লাখ টাকা মূল্যের গরুর চামড়া একশ’, দেড়শ’ টাকায় কিনেছি। দেড় থেকে দুই লাখ টাকামুল্যের গরুর চামড়া এবার দুশ’ থেকে তিনশ’ টাকা দামে কিনেছি। বর্তমান যা বাজারমূল্য তাতে কোরবানীদাতারা যে চামড়া বিক্রি করতে আসবে, বিক্রয়মূল্যে তো রিকশা ভাড়া উঠবে না। সে কারণে চামড়া সব মাদ্রাসাগুলোতে দিয়েছেন সবাই। মাদ্রাসাগুলো কিছু ফ্রী পাইছে, কিছু কিনছে। তারা আমাদের কাছেও কিছু বিক্রি করতে পারে, আবার ফুলতলা সুপারটেক্স লেদার ও নওয়াপাড়ায় ট্যানারিতে বিক্রি করে। সেখান থেকে তারা অগ্রিম অর্থও নিয়েছিল।’
অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রসেসিংয়ে একটি চামড়ার পেছনে দুই থেকে তিনশ’ টাকা খরচ হয়। ক্রয়মূল্য ও প্রসেসিং খরচ দিয়ে সপ্তাহখানেক পর বিক্রি করতে গেলে বুঝবো; লোকসান হবে কি না? কিনতে গেলেও তো ভয় রে ভাই, ট্যানারি মালিকরা টাকা দেয় না। গত বছর ৭০ লাখ টাকার চামড়া দিয়ে একটি পয়সাও পাননি খুলনার চামড়া ব্যবসায়ী শফি। তিনি অর্থসংকটের ও ঋণের চাপে দুশ্চিন্তায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন, কথাও বলতে পারেন না। কয়েকজন ব্যবসায়ী মারাও গেছেন। খুলনার ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০ কোটি টাকা অনাদায়ী পড়ে আছে ট্যানারিতে। কোন সরকার খুলনার প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীদের একটি পয়সা সহায়তা করেনি। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে ট্যানারি মালিকদের। অথচ চামড়া শিল্প রক্ষায় প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণও দেয়নি। ঈদের সন্ধ্যায় বৃষ্টি না হলে হাজার হাজার চামড়া নষ্ট হতো বলে যোগ করলেন তিনি।’
খুলনার বাগমারাস্থ মারকাযুল উলূম মাদ্রাসার মোহতামিম মুফতী আব্দুল্লাহ ইয়াহইয়া বলেন, ‘মাদ্রাসায় চারশ’ পিচ চামড়া দান করেছেন কোরবানীদাতারা। ফুলতলা সুপারটেক্সে দিয়েছি, সপ্তাহখানেক পর দাম দেবেন তারা। একটা সময়ে দশ/বারো লাখ টাকা চামড়া বিক্রি করে লিল্লাহ্ বোডিং, হেফজ বিভাগ ও মাদ্রাসা উন্নয়নে পাওয়া যেতো, এখন দুই লাখ টাকার মতো পাওয়া যায়। ফলে মাদ্রাসার অর্থ সংস্থানে ব্যাপক ঘাটতি থেকে যায়। এবার একটি চামড়াও আমরা কিনি নাই। মানুষ যা দান করেছেন তাই।’
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ খুলনা মহানগর সভাপতি মুফতি গোলামুর রহমান বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া গরীব ও ইয়াতিমদের হক। চামড়ার দাম কমিয়ে মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে, ইয়াতিমদের কোরআন শিক্ষার পথে বাঁধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ফুলতলার সুপার এক্স লেদার লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মোঃ মাসুম মিয়া বলেন, “খুলনার মাদ্রাসাগুলোর লবন ছাড়া চামড়া কিনে নিজেরাই প্রসেসিং করতেছি। ঈদেরদিন ১০ হাজার পিচ চামড়া সংগ্রহ করেছি। পরিবহন সমস্যার কারণে ঈদের দিন সব মাল এসে পৌঁছায়নি, রবি ও সোমবারও কিছু চামড়া আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক মার্কেট খুবই খারাপ। ৪০ থেকে ৪৬ সেন্ট বিক্রয়মূল্য চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারে। সেখানে ৪৬টাকা কেমিকেল খরচ। বিক্রয় মূল্য থেকে ক্রয়মূল্য যোগ অন্যান্য খরচ সমান সমান করলে দেখা যাচ্ছে- প্রতিটি চামড়া ২০-২৫টাকা লোকসান থাকছে। সারাদেশের দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারবো না! সরকার আমাদের কোন টাকাও দেয় নাই, কোন ব্যাংক লোনও পায় নাই। আমরা চাইছি- খুলনার মাদ্রাসাগুলো বাঁচুক, এতিম শিশুগুলো কোরআন শিক্ষা গ্রহন করুক। খুলনার যতো মাদ্রাসা থেকে ফোন করছে, আমরা বলেছি- চামড়া দেন, ন্যায্য দামে শুধু আপনাদেরটাই (মাদ্রাসার) আমরা নেবো। সে কারণেই মাদ্রাসা ব্যতীত বাইরের একটি চামড়াও আমরা কিনছি না। খুলনার মাদ্রাসাগুলো বাঁচানো জন্য শুধুমাত্র তাদের চামড়াগুলো কিনেছি।”
বাংলাশে ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, ব্যবসায় লাভ লোকসান থাকে। এবার হয়তো মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসান করবে না। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকবেন ট্যানারি মালিকরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষ ঘরবন্দী থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। অধিকাংশ মানুষ এখন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান এই তিনটি নিয়ে ভাবছে। জুতা বা চামড়ার পণ্য ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতিতে কেউ নেই। পৃথিবীর নামী-দামী শো’রুমগুলো বন্ধ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করেছি। কারণ, এসময়ের সংগৃহীত চামড়া দিয়েই আমাদের সারাবছর কাজ করতে হয়। ফ্যাক্টরি চালু রাখতে হয়। শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। সে কারণে ট্যানারি মালিকরাও লোকসান ঝুঁকিমুক্ত নন বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত্ব, ২০১৪ সালেও কোরবানির ঈদে দেশে গরুর চামড়ার বর্গফুট প্রতি দাম ছিল ৭০-৭৫ টাকা। চলতি বছর তা নেমে এসেছে ৩৫-৪০টাকায়। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে গরুর চামড়ার দাম ৫০ শতাংশ কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর গত বছরের তুলনায় দাম কমেছে ২৯ শতাংশ।
খুলনা গেজেট/এআইএন