স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা রাজনৈতিক দল বিএনপির গন্তব্য কোথায় ? দলটির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কি ফিরতে পারবেন রাজনীতিতে? এমন অনেক প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম এই রাজনৈতিক দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে।
দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজনীতিতে আপাতত সক্রিয় হওয়ার সুযোগ নেই বেগম খালেদা জিয়ার। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সরাসরি দল পরিচালনার দায়িত্বও নিচ্ছেন না তিনি। ছেলে তারেক রহমানই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া পেছন থেকে ভূমিকা রাখবেন অভিভাবকের মতো। দেবেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা । ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের নীতিনির্ধারকদের সাথে পরামর্শ করে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাবেন বলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
অসুস্থ খালেদা জিয়াকে গতবছর ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়। এর আগে তিনি টানা ২৫ মাস কারাবন্দী ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পরপরই দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন।
তারেক রহমান ২০০৮ সালের পর থেকেই লন্ডনে রয়েছেন। এক-এগারো সরকারের সময়ে কারাগারে চরম অসুস্থ হয়ে পড়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তখন তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পেয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে যান। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। তবে বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে ইচ্ছা থাকলেও দেশে ফিরতে পারছেন না।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, দেশে ফিরতে না পারলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনায় তিনি সরাসরি ভূমিকা রাখছেন। একটি সুসংঠিত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তিনি গড়ে তুলেছেন। দলের নীতিনির্ধারণী সব সিদ্ধান্তই তার কাছ থেকে আসছে। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতারা তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন অথবা প্রয়োজন মনে করলে তারেক রহমান নিজেই সবার মতামত নিয়ে বৃহৎ এই দলটি পরিচালনা করছেন।
খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে তিনি বলতে গেলে পরিবারের কয়েকজন সদস্য ছাড়া কাউকে সাক্ষাৎ দেননি। মাঝে মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাক্ষাৎ দেন খালেদা জিয়া। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন। করোনার কারণে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিয়ে নেতারা খালেদা জিয়াকে দেখতে যান। এছাড়া দল ও দলের বাইরে প্রভাবশালী কিছু নেতাও তার সাথে এরই মধ্যে দেখা করেছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকুন আর বাইরে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকুন, তিনিই দলের প্রধান অভিভাবক। খালেদা জিয়া মানেই বিএনপি। জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রেরণার উৎস তিনি। সাংগঠনিক যেকোনো বিষয়ে তার নির্দেশনা দল বাস্তবায়ন করবে। তবে যেহেতু তিনি অসুস্থ আর দেশে এখন রাজনীতির পরিবেশ নেই, সে কারণে তিনি সরাসরি দল পরিচালনায় আসছেন না।
ওই নেতার কাছে প্রশ্ন ছিল, সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া মুক্তিতে আছেন, সেক্ষেত্রে রাজনীতি করতে পারবেন কিনা? জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলাই বিএনপির প্রধান অগ্রাধিকার।
মুক্তির পর গত এক বছরেও খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা শুরু হয়নি। করোনার কারণেই সেটি সম্ভব হচ্ছে না। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় দলীয় চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি টিম রয়েছে। তাদের এক-দুইজন নিয়মিত খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার ফলোআপ করছেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যে কারণে ম্যাডামকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, সে কারণ এখনো রয়েছে। করোনার কারণে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি। তার চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়নি। স্বাভাবিক কারণে প্রয়োজনবোধে আবারো সরকার সময় বৃদ্ধি করতে পারে মানবিক কারণে। তবে এটির জন্য আবেদন করতে হবে। যেহেতু তার মুক্তির প্রক্রিয়াটি নির্বাহী আদেশে হয়েছে, সে কারণে আবারো আবেদন করার মধ্য দিয়ে সময় বাড়ানোর অনুরোধ করতে হবে।
খালেদা জিয়ার সক্রিয় অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনা করছেন মূলতঃ তারেক রহমান। কিন্তু তিনি দেশে না থাকায় দলকে সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে তোলার কাজটি বারবার হোঁচট খেয়েছে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে চলে আসছে। অবিশ্বাস আস্থাহীনতার বিষয়টিও অন্দরমহলে আলোচিত। সিনিয়র নেতাদের শোকজের মতো ঘটনাও ঘটেছে। দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ বেশ জোরে সোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। প্রকাশ্যে নেতারা যাই বলুক না কেন, দলে ছন্দহীনতা দৃশ্যমান।
এরই মধ্যে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে খালেদা জিয়ার প্রেস সেক্রেটারি বিশিষ্ট সাংবাদিক মারুফ কামাল খানকে। তাঁর বিরুদ্ধে নাকি দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনার অভিযোগ আছে। এর আগে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় বিএনপির অনুষ্ঠানের ব্যানার থেকে ‘বাদ’ দেয়া হয়েছে খালেদা জিয়াকে । যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন কর্মী সমর্থকরা। অয়োজকরা এর একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করলেও তা খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিতে সকলের আস্থার প্রতীক বেগম খালেদা জিয়ার সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু, বা আদৌ আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দিহান দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। আর এ অবস্থায় দলের গন্তব্যও বা কোথায় ? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব নেই দলের দায়িত্বশীল কারোর কাছে। হয়তো সময়ই সব বলে দেবে।
খুলনা গেজেট/এনএম