খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

খালিশপুর নেভাল বেজে নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন সাংবাদিক কাজী খালেক

কাজী মোতাহার রহমান

কাজী আব্দুল খালেক। আদি বাসিন্দা দৌলতপুর সংলগ্ন গাইকুড় গ্রামের। তিনি মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন পাকিস্তান অবজারভার নামক ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায়। খুলনার সাপ্তাহিক আওয়াজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সৃজনশীল মানুষ।

১২ মার্চ, ১৯৭১ সাল, সময় বেলা তিনটা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও বিহারীরা সশস্ত্র অবস্থায় তার দৌলতপুরস্থ বাড়ি ঘিরে ফেলে। দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল তার বুকে চেপে ধরে। তাকে উদ্দেশ্য করে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার প্রশ্ন ‘তুম বাঙালি হায়, না বিহারী হায়’। উত্তরে তিনি জানান ‘হাম পাকিস্তানী মোহাজির হায়’। তার দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘তুম আওয়ামী লীগ মে হায়, তুম আওয়ামী লীগ মে ভোট দিয়ে’। উত্তরে তিনি বলেন ‘মাই আওয়ামী লীগকো সাপোর্ট কিয়া, আওর আওয়ামী লীগ মে ভোট দিয়া, ৯৯ পারসেন্ট লোকনে আওয়ামী লীগ মে ভোট দিয়া, তো হামভী দিয়া, মাগার মাই আওয়ামী লীগ মে ইলেক্টেড মেম্বর নেহি হায়’। পাকিস্তানী সেনারা বাড়ির বাইরে এনে তাকে ট্রাকে তোলে। ট্রাকে আরও ৭-৮ জন বাঙালি ছিলেন। তার মধ্যে খালিশপুরের পুলিশের ডিএসপি ও ওয়াপদার একজন কর্মকর্তা ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার রক্তাক্ত শরীর ও ওয়াপদার কর্মকর্তার মুখের এক পাটি দাঁত ভাঙ্গা ছিল। একজন সেনা কর্মকর্তা কাজী খালেককে দেখে প্রশ্ন করে ‘তুম বাঙালি হায় না বিহারী হায়’। তার উত্তরে তিনি জানান‘ পাকিস্তানকা মোহাজের হায়’। পাল্টা প্রশ্ন ‘তোমহারা আইডিন্টিটি কার্ড হায়’। আইডিন্টিটি কার্ড দেখানোর পর এবং নিখুঁতভাবে ঊর্দু বলতে পারায় সেনারা সে যাত্রায় তাকে ছেড়ে দিয়ে যায়।

দ্বিতীয় ঘটনা ৭ জুলাই। দৌলতপুর থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মহাকুমা হাকিমের আদালতে নিয়ে যায়। তখন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ বাধ্য হয়ে তাকে জেল হাজতে পাঠায়। জেল হাজতে যেয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা, কলেজের শিক্ষক ও বাঙালি পুলিশ অফিসারদের দেখতে পান। তাদের শারীরিক অবস্থা শোচনীয়। কেউ শারীরিকভাবে দুর্বল আবার কারও গায়ে চুলকানি পাঁচড়া। প্রথম দিন তাকে জেল হাজতের ছোট্ট একটি কক্ষে রাখা হয়। এই কক্ষের ধারণ ক্ষমতা ৫০ জন। অবস্থান করে ৪শ’ জনের বেশী কয়েদী। প্রত্যেককে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে হয়। রাতে পাকিস্তানী সেনারা কারাগার থেকে কয়েদীদের নিয়ে যেত। কয়েদীরা আর ফিরে আসত না। সেনারা সার্কিট হাউজ ময়দানে নানা বয়সী বাঙালিদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করত, ভৈরব নদের পাড়ে নিয়ে জবাই করে লাশ ফেলে দিত।

কারাগারে আসামী ও কয়েদীদের যে ডাল ও ভাত দেয়া হত তা খাওয়ার রুচি কারও থাকতো না। আসামী কয়েদীদের এই কক্ষের এক কোণায় টয়লেট, দুর্গন্ধে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য। ৯ জুলাই মহাকুমা হাকিমের আদালতে ৫শ’ টাকা সিকিইরিটির ভিত্তিতে জামিন হয়। আত্মীয় স্বজনরা তার জামিনের খবর কারাগারে পৌঁছে দেয়। কারাগার থেকে নৌ সেনারা তাকে খালিশপুর নেভাল বেজে নিয়ে যায়। সেখানে বিহারী হত্যার মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নেভাল বেজের নৌ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন কর্ণেল গুলজারিন। নৌ কর্মকর্তা তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করত তুমি কত বিহারীকে হত্যা ও নির্যাতন করেছ।

উত্তরে তিনি বলতেন, আমি বিহারী হত্যার সাথে সম্পৃক্ত নই। সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে তাকে নেভাল বেজের জঙ্গল পরিস্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে কাঁচিতে আঙুল কেটে দুই ভাগ হয়ে যায়। তিন দিন এভাবেই কাজ করতে হয়। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত আবার ২টার কিছুক্ষণ পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘাস কাটতে হত। খাবার ছিল একটা রুটি। এরই মধ্যে একদিন যখন তিনি ঘাস কাটছিলেন একটি শিয়াল ঘাস বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ায় ঘাস নড়ছিল। নৌ সেনাদের ধারণা মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করেছে। সাথে সাথে তারা পজিশন নেয়। সেখানে মুক্তিবাহিনী আসেনি। তবুও তারা আতঙ্কগ্রস্ত। এরই এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন তাকে দেখে সিপাহীদের নির্দেশ দেয় কাজী খালেককে তার চেম্বারে নিয়ে আসতে। পাকিস্তানী এক ক্যাপ্টেন রোলার দিয়ে তার শরীরে আঘাত করে। ক্যাপ্টেন তার কাছে প্রশ্ন করে ‘তুম শালা বহুত বিহারীকো খতম কর দিয়া আওর বহুত বিহারীকো আওরাতকে ইজ্জত লিয়া’। তারপরে রোলার দিয়ে সেনা কর্মকর্তা কাজী খালেকের ওপর একের পর এক আঘাত করে। পায়ে শিকল দিয়ে উল্টো দিকে ঝুলিয়ে রাখতো। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতেন।

দু’দিন পর এ ঘটনা জানতে পেরে কর্ণেল গুলজারিন আহত কাজী খালেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, এ অপরাধে নেভাল ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনকে চট্টগ্রামে বদলী করে। নেভাল বেজে একজন পাঞ্জাবী ইমাম সেখানে আটক বাঙালিদের খাবার সরবরাহ করতেন। ৯ দিন নির্যাতন ভোগ করার পর ১৯ জুলাই খালিশপুর নেভাল বেজ থেকে কর্ণেল গুলজারিনের সহযোগিতায় তিনি মুক্তি পান। সেই সাথে তাকে পরামর্শ দেয়া হয় বিহারীদের এড়িয়ে চলবে। মুক্তি পেয়ে তিনি বোনের বাসায় চলে আসেন। তারপর তার পরিবার পরিজনদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ১৯৯৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কাজী খালেক ইন্তেকাল করেন।
(তথ্য সূত্র : তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ৮ম খন্ড ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে দেয়া ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই কাজী খালেকের সাক্ষাতকার)

খুলনা গেজেট/এ হোসেন




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!