সেতু (ছদ্ম নাম) বয়স ১৮ বছর। আবেগজনীত খাদ্যে অনীহার কারণে সেতুকে বর্তমানে হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। তার উচ্চতা ৫ ফিট ৫ ইঞ্চি হলে ও পূর্বে তার ওজন ছিল ৯৫ কেজি,যা তুলনামূলক বেশি।ওজন বেশি থাকার কারণে তাকে কুৎসিৎ দেখাতো। সবাই তাকে কেন্দ্র করে বিদ্রুপ মন্তব্য করতো। ফলে সেতুর মনের মধ্যে ওজন সংক্রান্ত এক প্রকার নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয় যা তকে ওজন হ্রাসে উদ্বুদ্ধ করে।
বর্তমানে সেতুর ওজন মাত্র ৪৬ কেজি। এখন খাবার খেলে সে প্রায় বমি করে।তিন মাস হলো তার ঋতুস্রাব বন্ধ।তার রক্তচাপ কমে গেছে,হৃদস্পন্দনে ছন্দ পতন এবং শরীরিরে ত্বক খসখসে হয়ে গেছে। মূলত: আবেগজনীত খাদ্যের অনিহার বিকৃতির (এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা- অহড়ৎবীরধ ঘবৎাড়ংধ) কারণে সেতুকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। সাধারণত: এ বিকৃতিটি ১৩ থেকে ১৮ বৎসরের মধ্যবর্তী সময়ে দেখা দিতে পারে।
কী ভাবে বুঝবেন আবেগজনীত খাদ্য অনিহা বিকৃতি: (১) ব্যক্তি তার বয়স ও উচ্চতার তুলনায় ওজন বাড়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।(২) তার ওজন বৃদ্ধিকে সে তীব্র ভাবে ভয় পায়।(৩) সে প্রায় মনে করে ওজন বৃদ্ধি পেলে তাকে খারাপ দেখাবে।(৪) ওজন বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে সে প্রায় দুশ্চিন্তায় ভোগে।(৫) মহিলাদের ক্ষেত্রে পর পর তিনটি মাস ঋতুস্্রাব বন্দ থাকতে পারে অথবা মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। (৬) রোগী প্রায় অতিদ্রুত ভোজন করে এবং তার পর গালে অঙ্গুল দিয়ে বা জোলাপ গ্রহন করে বমি করে। (৭) অত্যন্ত শীর্ণকায় হওয়ার পর ও সে প্রায় মনে করতে পারে, তার ওজন এখনো বেশি।(৮) রোগী ঘন ঘন ওজন মাপে।(৯) ব্যক্তি শরীরের বিভিন্ন অংশ পরিমাপ করে এবং আয়নার সামনে দাড়িয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে।(১০) এদের সামাজিক সম্পর্ক কমে যায়।
আবেগজনীত খাদ্য অনিহায় রোগীর যে সব শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে: (১) রোগীর রক্তচাপ কমে যায়।(২) রক্তে পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমে যায়। (৩) ঘন ঘন বমি করে। (৪) রোগীর ঘন ঘন পাতলা পায়খানা দেখা দেয়। (৫) রোগীর হৃদস্পন্দন হ্রাস পায়।(৬) ত্বক খসখসে হয়ে যায়।(৭) হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে। (৮) কারো কারের মাথায় চুল পড়ে যায়।
আবেগজনীত খাদ্য অনিহায় রোগীর যে সব মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে : (১) বিষণ্নতায় ভোগে। (২) রোগীর মধ্যে বাধ্যতা-ধর্মী প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। (৩) রোগী মধ্যে অমূলক ভীতি দেখা দিতে পারে। (৪) আতঙ্কজনীত বিকৃতি দেখা দিতে পারে।(৫) রোগী মধ্যে আত্মহত্যা প্রবনতা দেখা দিতে পারে।(৬) রোগী সুরাশক্তিতে মত্ত হতে পারে।
যে সব কারণে আবেগজনীত খাদ্য অনিহা বিকৃতি দেখা দেয় — (১) বংশগত কারণ: গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব মহিলাদের খাদ্যগ্রহণের বিকৃতি বিদ্যমান তাদের সন্তানদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাইরের লোকদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। (২) মস্তিষ্কের ভূমিকা: এ তথ্যে বিশ^াস করা হয় যে খাদ্য অনিহার জন্য মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের ভূমিকা বিদ্যমান। এতে আরো মনে করা হয়, এনোরেক্সিয়া রোগীরা যখন খাবার গ্রহন হতে বিরত থাকে,তখন তাদের শরীরের ভিতর অপিয়ম সদৃশ পদার্থ তৈরী হয়। এ পদার্থ রোগীর মধ্যে আনন্দানুভূতি তৈরী করে যা তাকে খাদ্য গ্রহনের বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।(৩) সামাজিক –সংস্কৃতির প্রভাব: বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মহিলাদের সৌন্দর্য বিচারে শীর্ণতাকে প্রাধন্য দেওয়া হয়। আর প্রত্যেক দেশের ছেলে মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য বিচারে সামাজিক মানদন্ডকে প্রাধন্য দিয়ে থাকে। আর সমাজে প্রচলিত মানদন্ডকে প্রাধ্যন দিতে গিয়ে ছেলে মেয়েরা খাদ্য অনিহায় অংশ নিতে পারে।(৪) লিঙ্গের প্রভাব: সৌন্দর্য পরিচর্যা বিচারে সাধারণত: মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা তুলনামূলক ভাবে উদাসিন। মহিলারা ক্ষীণদেহী হওয়ার ব্যাপারে বেশি সচেতন। সে কারণে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা সামাজিক মানদন্ডকে প্রাধন্য দিতে গিয়ে খাদ্য অনিহা প্রবনতায় বেশি আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
যাদের জন্য আবেগজনীত খাদ্য অনিহা ঝুঁকিপূর্ণ: যে সব ব্যক্তি কোন কাজ সবচেয়ে নিখুঁত ভাবে করতে চায়, যারা খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে থাকে, যারা লাজুক প্রকৃতির এবং বেশ বাধ্য অর্থাৎ তারা আদেশ মান্য করতে বেশ পছন্দ করে, যারা উদ্বেগাকুল প্রকৃতির ।
আবেগজনীত খাদ্য অনিহার চিকিৎসা ব্যবস্থা: (১) জৈবিক চিকিৎসা পদ্ধতি: খাদ্য গ্রহণের বিকৃতির সাথে বিষণ্নতা সহবস্থান করে, সে কারণে বিষণ্নতা বিরোধী ঔষধ ফ্লুওক্সেটিন ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। (২) মনোচিকিৎসা পদ্ধতি: এ প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যেমন- (ক) আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি: এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর ওজন বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক ভাবে কিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়। সঠিক ভাবে খাবার গ্রহন করলে পুরস্কার হিসেবে তাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, টেলিভিশন দেখতে সুযোগ দেওয়া, তার পছন্দ অনুযায়ী তাকে গান শুনতে দেওয়া যেতে পারে। (খ) পারিবারিক চিকিৎসা পদ্ধতি: এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে এনোরেক্সিয়া রোগীদের পারিবারিক সদস্যদের কাউন্সিলিং করা হয়। আলোচনার মাধ্যমে পারিবারে সদস্যদের মাঝে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব সমূহকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে সমস্যার পথ সমূহ বাতলানোর চেষ্ট করা হয়।
খাদ্যে আবেগজনীত সমস্যা অনেক সময় রোগীর জন্য জীবন মরণ সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত হয়। এ প্রকার সমস্যা শুধু মাত্র রোগী জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়,বরং পরিবারের জন্য একটা বড় সমস্যা হিসেবে প্রতিয়মান হয়। তাই এরুপ সমস্যা দেখা দিলে এক জন দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর স্বরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা গ্রহন করলে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব। ( লেখক: সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ )।