কয়লাসংকটে বন্ধ হয়ে গেছে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। শনিবার সকাল ৯টা থেকে কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। উৎপাদন শুরুর ২৭ দিনের মাথায় এ ঘটনা ঘটল।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগে বাগেরহাটের রামপালে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দুটি ইউনিটের। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষম এই কেন্দ্রের একটি ইউনিট গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিল। এর উৎপাদনক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। প্রতিদিন উৎপাদন করছিল ৫৬০ থেকে ৫৭০ মেগাওয়াট। আগামী ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার কথা।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কয়লার সরবরাহ না থাকায় গতকাল সকালে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে রামপালের এই কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। কেন্দ্রটি থেকে ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। বাকি বিদ্যুৎ খুলনায় সরবরাহ করা হতো। গত সপ্তাহে কারিগরি ত্রুটির কারণে এক দিন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় ঢাকার কিছু এলাকায় লোড শেডিং করতে হয়েছিল। কিন্তু গতকাল কেন্দ্রটি বন্ধ হলেও গতরাত ৮টা পর্যন্ত কোনো লোড শেডিং করা হয়নি বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কম্পানিগুলো। শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় রামপাল কেন্দ্র বন্ধের কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানান কর্মকর্তারা।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমোদন দিতে দেরি করছে। বিআইএফপিসিএল ঋণপত্র খুলতে না পারার বিষয়টি চিঠি দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) জানায়। গত ১০ ও ১১ জানুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে গতকাল মজুদ কয়লা শেষ হয়ে যায় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। কয়লা না পাওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রটি চালু করার সুযোগ নেই।
বিআইএফপিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন ৫৬০ থেকে ৫৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে আসছি। কয়লা না থাকায় (গতকাল) সকাল ৯টার দিকে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।’ কয়লাসংকটের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়লা আমদানিতে ডলার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার না দেওয়ায় কয়লা আমদানি করা যাচ্ছিল না। কেন্দ্রটির একটি ইউনিট পুরোপুরিভাবে চালু রাখতে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন হয়।
আনোয়ারুল আজিম জানান, রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়ায় কয়লাবোঝাই একটি জাহাজ প্রস্তুত হয়ে আছে। ঋণপত্র পাওয়া নিশ্চিত হলে জাহাজটি বাংলাদেশের পথে রওনা হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী রামপালের বিদ্যুৎ বিপিডিবিকে কিনতে হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী বিপিডিবিকে কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যয় বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, বিপিডিবির কাছে বিআইএফপিসিএলের ১৭ মিলিয়ন ডলার পাওনা হয়েছে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করছে না। এর মধ্যে বিপিডিবি তাদের কেন্দ্রটি চালিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। যার কারণে জরুরি মজুদ কয়লা দিয়েই এত দিন কেন্দ্রটি চালু রাখা হয়।
জানতে চাইলে বিপিডিবির কোল পাওয়ার জেনারেশনের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রুকন উদ্দিন বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই। ডলার সংকটের কারণে কয়লার পেমেন্ট করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খুবই জরুরি পণ্য ছাড়া ঋণপত্র খুলতে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় রাপমাল কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও সরবরাহে কোনো ঘাটতি হবে না। কারণ চাহিদার চেয়ে এখন উৎপাদন বেশি হচ্ছে।
বিপিডিবির কাছে বিআইএফপিসিএলের পাওনার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. রুকন উদ্দিন বলেন, ‘ভর্তুকির টাকা না পাওয়ায় আমরা বিআইএফপিসিএলের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। শুধু এই প্রতিষ্ঠান না, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাঁচ মাসের বকেয়া আটকে আছে। তবে আশা করছি, শিগগিরই এই সংকট কেটে যাবে।’
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র জানায়, ১৫ আগস্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে। প্রথম ইউনিটের পরীক্ষামূলক উৎপাদন ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছালে ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। সে সময় সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। ২৫ নভেম্বর থেকে টানা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরীক্ষামূলক উৎপাদন করে কেন্দ্রটি। ঢাকার বিদ্যুত্সংকট কাটাতে গত ১৭ ডিসেম্বর রাত থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু করা হয়।