এনামুল হক। মুর্শিদাবাদের লালগোলা থানার কুলগাছি গ্রামের ভূমিপুত্র। পাচার কাণ্ডের ‘গ্যাঙস্টার’ থেকে আজ তিনি কয়েকটি রাইস মিলের মালিক। এছাড়াও হক ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড ও হক মার্চেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক। তার ঝাঁ-চকচকে অফিসটি অবস্থিত কলকাতার অফিসপাড়া হিসাবে খ্যাত সেই বিবাদী বাগ বা ডালহৌসি এলাকার ২৭ নম্বর বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। আর এই অফিসে রাজনৈতিক রাঘববোয়াল থেকে আমলা-অফিসার-পুলিশকর্তা- আইনজীবী হেন মানুষ নেই যাদের আনাগোনা নেই। স্বাভাবিকভাবেই মনের মধ্যে এই প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এই পাচার গ্যাঙস্টার এনামুল হক কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। এর পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক রাঘববোয়াদের আশীর্বাদ ও পুলিশ-বিএসএফ ও কাস্টমসের সীমাহীন সহযোগিতা।
গত ৬ নভেম্বর রাজধানী দিল্লির এক হোটেলে হানা দিয়ে এনামুলকে গ্রেফতার করে সিবিআই। করোনার জন্য জামিন পেয়ে গেলেও তার কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক কিছুর হদিস পেয়ে যান সিবিআই কর্তারা। আর তার জের স্বরূপ ম্যারাথন জেরায় অবশেষে বিএসএফ কমান্ডান্ট সতীশ কুমারকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই।
আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, এই সতীশ কুমারের ছেলে একসময় এনামুলের সংস্থায় চাকুরি করতেন। পাচারের বীজটা কোথায় নিহিত, তা সহজে অনুমেয়। হয়তো সতীশ কুমারকে জেরা করে সিবিআই আরো অনেক রাঘববোয়ালদের নাম জানতে পারবে বা ইতিমধ্যেই অনেকটাই জেনে গেছে।
চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সিবিআই কেরালায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি নিয়ে এক বিএসএফ কর্তা ম্যাথুউজের বাড়িতে হানা দিয়ে পাচারের আসল সত্যটা জানতে পারে। তারপর ২৩ সেপ্টেম্বর কলকাতা-সল্টলেক-মুর্শিদাবাদের পরপর হানা দেয় সিবিআই। সিবিআই সতীশ কুমারের সল্টলেক ও গাজিয়াবাদের বাড়িতে হানা দেয়। তারপর জেরায় অসহযোগিতা করছেন বলে তাকে বিএসএফ গ্রেপ্তার করে কলকাতার নিজাম প্যালেসে।
প্রসঙ্গক্রমে এটাও বলতে হবে যে, এই এনামুলকে সিবিআই আরো কয়েকবার গ্রেপ্তার করে। তারপর ছাড়াও পেয়ে যান। কিন্তু কেন? ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাধর রাজনৈতিক রাঘববোয়ালদের আশীর্বাদেই কি তিনি ছাড়া পেয়ে যান? আমাদের আরো মনে রাখতে হবে, সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচার নতুন কিছু নয়। ২০১৪-১৫ সালে এই পাচারকাণ্ডের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রকাশ্যে আসে।
শিলিগুড়ি-চ্যাংড়াবান্ধা, মালদার বৈষ্ণবনগরের শোভাপুর, মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা, ধুলিয়ান-নিমতিতা কাস্টমস ঘাট, লালগোলা, ভগবানগোলা-আখেরিগঞ্জ রানীনগর, জলঙ্গি, নদীয়ার তেহট্ট, বেতাই, করিমপুর, হাঁসখালি-রামনগর , উত্তর চব্বিশ পরগণার বনগাঁ, বাগদা, স্বরূপনগর, বসিরহাট ঘোজাডাঙা——– বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গে পাচার যেন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। আমি মুর্শিদাবাদের উমরপুর মোড়ে এনামুলের ভাগ্নেদের ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি হোটেলকে জানি। এই হোটেলে রাজনীতির কারবারি থেকে সর্বস্তরের রাঘব বোয়াল ও আমলাদের যাওয়া-আসা ছিল।মুর্শিদাবাদসহ সীমান্তবর্তী জেলার এসপিরা কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল জেলা থেকে থানা পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর কেন্দ্রীয় শাসক দল বিএসএফ- সেনাবাহিনীর অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই দুইয়ের যোগফল অবাধ পাচার।
স্মরণ করা যেতে পারে, জলপাইগুড়ি-নেপাল সীমান্তে সোনা পাচারের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে যান এক বিএসএফের ডিআইজি, সেনাবাহিনীর কর্ণেল ও স্হানীয় এসডিপিও। তাহলে একথা সহজেই অনুমান করা যায়, এনামুল বা সতীশকুমার ক্ষমতাসীন দলেরই তৈরি করা ও আশীর্বাদপুষ্ট।
খুলনা গেজেট/এনএম