খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ মাঘ, ১৪৩১ | ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  দৈনিক ভোরের কাগজের প্রধান কার্যালয় বন্ধ ঘোষণা
  সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের

ক্যাপাসিটি চার্জেই ডুবেছে বিদ্যুৎ খাত

গেজেট ডেস্ক

সরকার গত সাড়ে ১৪ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ এক লাখ ৪ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এখনো আনুমানিক সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার মতো বকেয়া আছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিক্রির বিল বাবদ সরকারের কাছে তাদের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যেই ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ এই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকাও আছে। চুক্তি অনুযায়ী পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা মার্কিন ডলারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধু অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ক্ষমতা বাড়ানোর কারণে দিতে হয়েছে এই অর্থ। উৎপাদন না করলেও তাদের এই টাকা বসিয়ে বসিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। তাদের মতে, ক্যাপাসিটি চার্জে ডুবতে বসেছে বিদ্যুৎ খাত।

বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি। আর এই অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতাই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। উদ্বৃত্ত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে স্বস্তিতে নেই বিদ্যুৎ বিভাগও। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটা বড় বোঝা। বিদ্যুৎ বিভাগের দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা সামান্য পরিমাণ বেশি থাকতেই পারে। কিন্তু তা দ্বিগুণ করে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অলস বসিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অলস বসে থাকার কারণে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকুক বা না থাকুক, চুক্তি অনুসারে কেন্দ্রভাড়া পাবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, যাকে ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়। সরকার ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের যুক্তি হলো, কেন্দ্রভাড়া না দিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। বাসাভাড়া নিয়ে সেখানে কেউ না থাকলেও ভাড়া দিতেই হয়, তেমনি হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়ায় এনে সেখান থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও কেন্দ্র ভাড়া দিতে হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া ব্যয়ের চিত্র প্রকাশ করেন। তার দেওয়া হিসাব বলছে, এই সরকারের তিন মেয়াদে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৩টি আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী) ও ৩০টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ/রেন্টাল পেমেন্ট) পরিশোধ করেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট; বর্তমানে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রাহক চাহিদা গরমকালে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মেগাওয়াট এবং শীতকালে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এজন্য বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই চুক্তি অনুযায়ী তথাকথিত ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাবদ প্রতিবছরে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা করে গচ্চা দিতে হয়েছে সরকারকে।

বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা শাখা পাওয়ার সেল জানিয়েছিল নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর প্রয়োজন নেই। হিসাব অনুযায়ী ২০৩১ সালে দেশে চাহিদা দাঁড়াবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। আর অনুমোদন পাওয়া ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় থাকা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৪১ হাজার মেগাওয়াট। এরপরও নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও জ্বালানি-বিশেষজ্ঞদের মত, কেন্দ্র ভাড়া নির্ধারণ করতে হয় প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি হয়েছে প্রতিযোগিতা ছাড়া। এতে কেন্দ্র ভাড়া বেশি পড়েছে। বেশি লাভবান হয়েছেন বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ততটা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। ফলে সব সময়ই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশকে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়। আর স্বার্থান্বেষী মহলের অতি উৎসাহে রেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুযোগ দিতেই চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। বেসরকারি মালিকদের বিনিয়োগ উঠে গেলেও চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জ খুব একটা কমেনি। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সম্প্রতি যেসব কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে তাদের কাছ থেকে সরকার বিদ্যুৎ না কিনলেও এখন আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে না।

জানা গেছে, ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন দক্ষতা বা সক্ষমতার ওপর। অভিযোগ রয়েছে, চুক্তির সময় কেন্দ্রের সক্ষমতা কৌশলে বেশি করে দেখানো হয়, যাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি হয়। চুক্তিতে যে সক্ষমতা দেখানো হয়, সে অনুযায়ী কেন্দ্রগুলো উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারকে ঠিকই গুনতে হয়। ডিপিএ পাওয়ার জেনারেশন নামের কোম্পানির নারায়ণগঞ্জে ৫০ মেগাওয়াটের একটি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র ছিল। ডিজেলচালিত কেন্দ্রটির ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্ল্যান্ট-ফ্যাক্টর ছিল মাত্র ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। চুক্তির সময় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্ল্যান্ট-ফ্যাক্টর ধরা হয় ৮০ শতাংশের উপরে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডিপিএ পাওয়ার সরকারের কাছ থেকে আয় করে ২৪২ কোটি টাকা। ২০১০ সালের নভেম্বরে চালু হওয়া এই কেন্দ্রটির চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে উদ্যোক্তা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে পেয়েছেন ২৮৩ কোটি টাকা। এরপর আরও পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করা হয়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাঁচটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র সারা বছরে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ সময় চালু ছিল। বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থেকে এসব কেন্দ্র পিডিবির কাছ থেকে আলোচ্য অর্থবছরে এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা আয় করেছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম  বলেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালসহ শতাধিক প্রকল্প উৎপাদনে আনা হয়। তারপরও এগুলো থেকে মানসম্মত বিদ্যুৎ মেলেনি। দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। চাহিদা না থাকায় এসব কেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ থাকে। বসে থেকে বছর বছর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিচ্ছে। আবার সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে।

অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, বিভিন্ন মহলের স্বার্থজনিত নানা কারণে বিদ্যুৎ খাতে এ অবস্থা। তিন বছরের চুক্তিবদ্ধ রেন্টাল প্রকল্প ১০ বছরের জন্য ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েই চলেছে।

 

খুলনা গেজেট/এ বি




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!