‘মা আমার হারিয়ে গেছে,
খুঁজি তাকে সকাল-সাঁঝে।
মা নামের মধুর ডাকটি হবে না আর ডাকা,
মায়ের কোলে শুয়ে আর হবে না কোনো কথা।’
তোমার শূন্যতা অপূরণীয় মা। বাবাকে সবসময় কাছে না পেলেও তুমিই ছিলে বাবা আর তুমিই আমার মা। তোমার শাসন, রাগ, অভিমান আর ছেলেমানুষী খুবই মিস করি মা।
এই তো সেদিনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বললে- ‘কখন আসবি, তোর অপেক্ষায় আছি। খিদে লাগছে, তুই আসলে খাব।’ হাসপাতালে যেতেই আগে আমাকে খাওয়ানোর জন্য জিদ শুরু করলে। অথচ তুমি অসুস্থ, খাবার খেয়ে ওষুধ সেবনের কথা তোমার। আমি বললাম- মা খেয়ে নাও, আমি একটু পড়ে খাব। তুমি জিদ ধরলে- ‘তুই না খেলে আমি খাব না।’ এখন আর কেউ এমন জিদ করে না মা। এখনতো আর অফিসে থাকা অবস্থায় ফোন করে কেউ জানতে চায় না, ‘তুই কখন আসবি? সাবধানে তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।’ এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় এই তোমার কল এসেছে। কলিজাটা কেঁপে ওঠে। তুমিতো আমার কলিজার টুকরা মা, তোমার জন্য বুকটা হাহাকার করে।
সাত সন্তানের জননী আঞ্জুমানয়ারা বেগম (৬৫) ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট সকাল ৬টার দিকে খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এই রত্নগর্ভা মায়ের দুই মেয়ে ও পাঁচ ছেলে। ছোট থাকতেই সেজো ছেলে মাসুম হোসেন বাবু বাগেরহাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে হারিয়ে যান। সে বেঁচে আছে না মারা গেছে শেষ সময়েও জানতে পারেননি আঞ্জুমানয়ারা বেগম। ২০০৮ সালে মারা যান বড় ছেলে হুমায়ুন কবির। দুই সন্তানকে হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে বাকি ৫ সন্তানকে আঁকড়ে রাখেন তিনি। চাকরির সুবাধে স্বামী অন্যত্র অবস্থানের কারণে সন্তানদের বাবার শূন্যতা বুঝতে দেননি তিনি। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করতে কতোই না কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিয়েছেন তিনি। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, মানুষের মতো মানুষ করেছেন। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে স্বামীকে হারান তিনি।
স্বামী ও দুই সন্তান হারানো আঞ্জুমানয়ারা প্রায় ৭ বছর ছিলেন অসুস্থ। ডায়াবেটিকস, হাইপ্রেসার, পায়ের ব্যথা, হার্টের সমস্যার রোগে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসকদের পরামর্শে হাসপাতালে নিলেও সেখানে থাকতে চাইতেন না। বলতেন, ‘আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করলে দেখিস আমি আর বাড়ি ফিরব না।’ তার কথাই সত্য হলো। ফিরেছিল তার নিথর দেহ।
আঞ্জুমানয়ারা বেগমের সাত সন্তানের মধ্যে ৬ষ্ঠ ছেলে আমি। মাকে খুব খুশি হতে দেখেছিলাম ২০২১ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি। যেদিন আমি ঢাকা পোস্টের সেরাকর্মী হয়েছিলাম। মা আমার সেরাকর্মী হওয়ার নিউজটি পড়ে সবাইকে ফোন করে খুশির কথা জানাতে বলেছিলেন। খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। সন্তানের সুসংবাদে মায়ের হাসি দেখে কতোটা ভালো লাগে আমি সেদিন বুঝেছিলাম।
মায়ের শেষ কথা ও স্মৃতি মনে পড়ে সব সময়। মা মারা যাবার আগের রাতে প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যেও জ্ঞান ফিরলে তার কপালে চুম্বনের সময় বললেন- ‘কাঁদিস না, শুধু আমার জন্য দোয়া করিস।’ মাগো তোমার স্মৃতি সবসময় আমায় কাঁদায়। যখনই একা থাকি, তোমার স্মৃতি আমাকে কাঁদায়, বুকটা খালি খালি লাগে। মনে হয়, সব হারিয়ে ফেলেছি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি মা তুমি যেন জান্নাতবাসী হও। হে আল্লাহ এই এতিম সন্তানের দোয়া কবুল করুন, আমার মাকে জান্নাতবাসী করুন, আমিন।
আঞ্জুমানয়ারা বেগমের বড় মেয়ে লাবনী ইসলাম সাথী। মায়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ছোট থেকে মা আমাদের অনেক কষ্টে লালন-পালন করেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মায়ের একটা কথা সব সময় আমাকে কাঁদায়। বাড়ির পাশেই আমারও বাসা থাকার সুবাধে মা প্রায় বলতেন আমার কাছে রাতে থেকে যাও। আমি বলতাম থাকবানি মা। তবে পরবর্তীতে স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশের বাহিরে অবস্থান করার কারণে মায়ের মৃত্যুর সময় আসতে পারিনি। এখন প্রতিনিয়ত মায়ের সেই কথাটি আমাকে কাঁদায়।
মা আমাদের সব ভাই-বোনকে ভালোবাসতেন। তার মধ্যেও তার ছোট ছেলে মিলন ও মেয়ে মুক্তাকে বেশিই ভালোবাসতেন। মিলন বর্তমানে সাংবাদিকতার পেশায় রয়েছে। ছোট ছেলে মিলনকে ছাড়া ঘরের বাহিরেও বের হতেন না। এমনকি নিজের পিত্রালয়েও থাকতেন না। ছেলে কখন অফিস থেকে বাসায় ফিরবে, কি খাবে? এসব চিন্তাই বেশি করতেন। ফোন দিয়ে শুনতো কখন আসবি, আমাদের বলতো মিলনকে কল দাও, কোথায় আছে শোনো। এভাবেই মা আমাদেরকে আকড়ে রেখেছিলেন। কখনো বলা হয়নি মা তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। দোয়া করি আল্লাহ মাকে জান্নাতবাসী করুক। আমিন।
খুলনা গেজেট/এএজে