কোটাপ্রথা নিয়ে এবারের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে আন্দোলন থেমে গিয়েছিল। পরে আদালতের এক রায়ের পরে দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয় গত জুন থেকে। এরপর তা ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নেয়। এ অবস্থায় সরকার সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় ১৭ জুলাই। ফলে বন্ধ থাকে অনলাইন সংবাদমাধ্যম। আন্দোলন শুরু থেকে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তা তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
আন্দোলনের প্রথম পর্যায়: ২০১৮ সাল
৩১.১.২০১৮
সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল করে পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিকের পক্ষে রিট দায়ের। রিট দায়ের করে আইনজীবী এখলাছ উদ্দিন বলেছিলেন, ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশে সরকারি, বেসরকারি, প্রতিরক্ষা, আধা সরকারি এবং জাতীয়করণ করা প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য কোটা প্রবর্তন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে কোটায় সংস্কার ও পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা বিদ্যমান। ফলে যাঁরা কোনো কোটায় পড়েন না, তাঁদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য।
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে-বিপক্ষে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছে দুটি পক্ষ। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদের’ ব্যানারে কয়েক শ চাকরিপ্রার্থী কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। আর সংস্কার প্রস্তাবের নামে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের’ প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের নেতা-কর্মীরা। তবে পুলিশ সেখানে কাউকেই দাঁড়াতে দেয়নি।
আন্দোলন চালিয়ে নিতে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
৯ এপ্রিল, ২০১৮
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে চাকরিপ্রার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ১৭ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। এরপর ৪ মার্চ মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে আন্দোলনকারীরা ১৩ মার্চ পর্যন্ত সরকারকে কোটা সংস্কারের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ ভাগ থেকে ১০ ভাগে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য থাকা পদগুলোতে মেধায় নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না রাখা, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা-সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা।
এদিন কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে বেলা দুইটার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে হাজারো শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী গণপদযাত্রা করে বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে বেলা তিনটায় শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন, জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাবেন। রাত পৌনে আটটায় আকস্মিকভাবে শিশুপার্কের দিক থেকে ১৫-২০ প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে করতে শাহবাগ মোড়ের দিকে আসতে থাকে। তারা আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা শুরু করে। পুলিশের আকস্মিক হামলায় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দুই ভাগ হয়ে যান।
এরপর থেকেই মূলত আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা শুরু। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদের নেতাদের ওপর বারবার হামলা করে ছাত্রলীগ। আন্দোলনের একপর্যায়ে ২০১৮ সালের জুনে জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। আর এ নিয়ে সরকার পরিপত্র জারি করে ৪ অক্টোবর। এরপর ২০২১ সালে এই পরিপত্র বাতিল চেয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট দায়ের করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়: ২০২৪ সাল
৯ জুলাই, মঙ্গলবার
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থীর আবেদন। শুনানি হবে পরদিন। অবশ্য ওই দুই শিক্ষার্থীর আবেদন করার সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা চার ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ জুলাই, বুধবার
সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ আপিল বিভাগের। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন রাখা হয়।
শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমরা এই সমাজের মানুষ, কিছু কথা বলতেই হয়। সেটি হচ্ছে যে একটা রায় হাইকোর্টে হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। সেখানে তারা যেটা করেছে, এটা অ্যাপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) করার মতো না। মনে হয়, তারা ভুল বুঝেই করেছে। যা-ই হোক যেটিই করেছে, তারা আমাদেরই ছেলে-মেয়ে।’
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম, তখন একটি মামলায় বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না।’
অন্যদিকে সরকারি চাকরির সব পদে কোটা সংস্কারের দাবি করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাঁরা মনে করছেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।
সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।
এ দিন পুলিশের বাধার মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ পালন করেন আন্দোলনকারীরা।
১২ জুলাই, শুক্রবার
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। রেলপথ অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
১৩ জুলাই, শনিবার
সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা। পরের দিন রোববার গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর এ স্মারকলিপি দেবেন আন্দোলনকারীরা।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের এখন কিছু করার নেই।
১৪ জুলাই, রোববার
গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান করতে হবে।’ শেখ হাসিনা আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’
মধ্যরাতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। মিছিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও।
রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভের পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন।
১৫ জুলাই, সোমবার
বেলা দুইটায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুপুর দুইটায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।
এর পরে দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
বেলা তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়। গুলি করতেও দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়। আহত ২৯৭ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেন।
হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগে উভয়েরই সমাবেশ করার ঘোষণা।
১৬ জুলাই, মঙ্গলবার
সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার সমর্থকেরা। এতে নিহত হন ছয়জন। রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ।
বিকেলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছুই মনে রাখা হবে এবং জবাব দেওয়া হবে। একটি ঘটনাও জবাব ছাড়া যাবে না। রাজাকারদের ফাঁদে পড়ে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে আমরা দেখে নেব, কত ধানে কত চাল হয়।’
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বুধবার গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করবেন তাঁরা।
১৭ জুলাই, বুধবার
সারাদেশে সংঘাত, নিহত ৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা।
ছুটির দিনেও ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন।
রাত সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ। একই সঙ্গে তিনি আন্দোলনকারীদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।
প্রায় আট মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
দেশের ৪৭টি জেলায় বিক্ষোভ, নিহত ২৭
দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলি। মোট নিহত ২৭ জন। (নিহতের সংখ্যা ওই দিন পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবারই পরদিন হালনাগাদ করা হয়েছে।) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল। রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার। কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়।
‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ দলে দলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে সংঘর্ষের এসব ঘটনা ঘটে।
সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন।
১৯ জুলাই, শুক্রবার
সারা দেশে নিহত ৫৬ জন, রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়।
এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হন। আর সারা দেশে নিহতের সংখ্যা ছিল ৫৬ জন। আহত হন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ কয়েক শ। শুরু থেকে এ আন্দোলনে ছিলেন শুধু শিক্ষার্থীরা। তবে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় লোকজনকেও অংশ নিতে দেখা গেছে।
আন্দোলনকারীরা জানান, ৯ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত চলবে ‘শাটডাউন’।আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির মধ্যে রয়েছে—
১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিপরিষদ ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
২. ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহীদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে।
৪. যে সকল পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে আটক করে এবং হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার দেখাতে হবে।
৫. দেশব্যাপী যে সকল শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহীদ ও আহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগসহ দলীয় লেজুরবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদকে কার্যকর করতে হবে। ৭. অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে।
৮. আর যে সকল ছাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের কোনো ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
৯. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে গত তিন দিনে সারা দেশে নিহত হন ১০৩ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার নিহত হন ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪১ জন এবং শুক্রবার নিহত হন ৫৬ জন।
রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ।
২০ জুলাই, শনিবার
দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন। সাধারণ ছুটি ঘোষণা। নিহত ২৬। সব মিলিয়ে চার দিনে নিহত ১৪৮।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে শনিবার নিহত ২৬। সব মিলিয়ে চার দিনে নিহত ১৪৮। এর মধ্যে মঙ্গলবার ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪১ জন, শুক্রবার ৭৫ জন এবং শনিবার ২৬ জন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ।
আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ।
কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রো স্টেশনে বিপুল ক্ষতি। গত শুক্রবার সরকারি তিন স্থাপনায় আগুনে ১১৩ যানবাহন পুড়ে ছাই হওয়ার খবর।
২১ জুলাই, রোববার
আপীল বিভাগে রায়ে ৯৩% মেধা কোটা। পাঁচ দিনে মৃত্যু বেড়ে হয়েছে ১৭৪
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রদান। রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
এদিকে পাঁচ দিনে মৃত্যু বেড়ে হয়েছে ১৭৪। আহত কয়েকজনের মৃত্যু হওয়ায় এবং আগের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার কারণে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার নিহত হন ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪১ জন, শুক্রবার ৭৫ জন, শনিবার ২৬ জন এবং রোববার ১৯ জন।
আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন। হাসপাতালে ভর্তি।
২২ জুলাই, সোমবার
সংঘর্ষে আরও ১৩ জন নিহতের খোঁজ পাওয়া গেছে।
কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সংঘর্ষে আরও ১৩ জন নিহতের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নারায়ণগঞ্জে তিনজন গত শনিবার মারা যান, যাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয় সোমবার। আর রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) গত শুক্রবার চারটি মরদেহ নেওয়া হয়েছিল বলে সোমবার খবর পাওয়া যায়। এর বাইরে একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর তথ্য এদিন জানা যায়। সব মিলিয়ে ছয় দিনে মোট ১৮৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। তাঁদের মধ্যে মঙ্গলবার ৬, বৃহস্পতিবার ৪১, শুক্রবার ৭৯, শনিবার ৩৬, রোববার ২০ ও সোমবার ৫ জন নিহত হয়েছেন।
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার
কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি।
মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে ১৯৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর এই হিসাব কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া। সব হাসপাতালের চিত্র পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া (২২)। তিনি গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হন।
মঙ্গলবার নতুন করে খোঁজ পাওয়া যায় আরও আটটি মৃত্যুর। এর মধ্যে ঢাকার ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে পাঁচজন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজনের মৃত্যু হয়। সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ পাওয়া গেছে নিহত আরেক ব্যক্তির।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) ৬, বৃহস্পতিবার ৪১, শুক্রবার ৮৪, শনিবার ৩৮, রোববার ২১, সোমবার ৫ এবং মঙ্গলবার দুইজনের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, গত সোম ও মঙ্গলবারের মৃত্যু চিকিৎসাধীন অবস্থায় হয়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো