কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে গেলো সপ্তাহজুড়ে রাজধানী ছিল প্রায় অচলাবস্থায়। আন্দোলনকারীরা নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে যান চলাচলে বাধা দেওয়ায় নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ শিকার হতে হয়েছে। গত বুধবার (১০ জুলাই) হাইকোর্ট চার সপ্তাহের জন্য কোটার স্থিতাবস্থা জারি করার পর থেকে আন্দোলনে নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। তবে খুব একটা সফল হতে পারেনি পুলিশ। বিশেষ করে গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ ঠেকাতে শাহবাগ মোড়ে কয়েকশ পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েও আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে পারেনি। সূত্র বলছে, যেকোনও মূল্যে চলতি সপ্তাহে কোটা আন্দোলনকারীদের থামাতে চায় পুলিশ।
বৃহস্পতিবার শাহবাগে কোটা আন্দোলনকারীদের থামাতে ব্যর্থ হয়ে শুক্রবার (১২ জুলাই) শাহবাগ থানায় ‘পুলিশের যানবাহনে ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা এবং মারধরের’ অভিযোগে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে পুলিশ। মূলত এরপর থেকে প্রশ্ন উঠেছে যে, এবার কি তাহলে কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাচ্ছে পুলিশ?
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কোটা আন্দোলনকারীরা আদালতের নির্দেশ অমান্য ও সড়ক অবরোধ করে প্রচলিত আইনে অপরাধ করছেন। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করছেন। পুলিশ অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। এখন সময় এসেছে তাদের লাগাম টেনে ধরার। কোটা আন্দোলনের নামে রাজধানীতে অচলাবস্থা ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টির আর ছাড় দেওয়া হবে না।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরু থেকে কোটা আন্দোলনকারীদের গতিবিধির ওপরে নজর রাখছিলেন তারা। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে পর্যায়ক্রমে মানুষের জানমালের ক্ষতি করছেন। নগরবাসীকে নানাভাবে চরম দুর্ভোগে ফেলছেন। তবুও পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছে। পুলিশের ওপর এমনও নির্দেশা ছিল— তারা যেন কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে না জড়ায়। পুলিশকে শেষ মুহূর্তেও ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশনা দেওয়া ছিল। তবে এবার কোটা আন্দোলনকারীদের লাগাম টানতে নানান কৌশল গ্রহণ করছে পুলিশ।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন শনিবার (১৩ জুলাই) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোটা নিয়ে আদালতের নির্দেশনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অযৌক্তিক ও আইন পরিপন্থি। তাদের কয়েক দফা অনুরোধ করা হয়েছিল। তারপরও তারা রাস্তায় নেমে আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধ করে জনসাধারণ ও রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি করছে। তাই আন্দোলনের নামে রাস্তা অবরোধ করতে দেওয়া হবে না। শুধু তাই নয়, রবিবার (১৪ জুলাই) থেকে সড়কে নামলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শনিবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে কোটা আন্দোলনকারীদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী, বৈষম্য ও অযৌক্তিক কোটা সংশোধন করে সংসদে আইন পাসের জন্য রবিবার সকাল ১১টায় রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও গণপদযাত্রা করা হবে।
শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ ৭ জন। তাদের আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ৫ জুন হাইকোর্টের এমন রায়ের পর থেকেই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। পরে ১ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের রায়ের পর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে মাঠে নামেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। গত রবিবার (৭ জুলাই) থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। মুহূর্তেই সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মাঝে একদিন বিরতি দিয়ে বৃহস্পতিবার চতুর্থ দিনের মতো এই কর্মসূচি পালন করেন তারা।
‘বাংলা ব্লকেড’ চলাকালে গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। এদিন, কুমিল্লা ও ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্র বলছে, কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে কোন কোটা কীভাবে কমানো যেতে পারে, তা নিয়ে সরকারের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার চাইছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান দিতে। অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলাপ হচ্ছে দফায় দফায়। প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে দেশে ফেরার পরও সরকারের ওপর মহলে আলাপ হয়েছে বিষয়টি নিয়ে।
খুলনা গেজেট/কেডি