ড্রাম ভর্তি কেমিক্যাল থাকার বিষয়টি সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ গোপন করায় প্রাণ গেল ১০ জন ফায়ার ফাইটারের। এছাড়াও ঐ কনটেইনার ডিপোর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসছে।
যদিও কাস্টমসের ছাড়পত্র ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো দাহ্য কেমিক্যাল মজুত করা হয়েছিল— দাবি প্রতিষ্ঠানটির। তবে বিস্ফোরক পরিদপ্তর বলছে, তাদের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এমনকি তালিকায়ও নেই এ প্রতিষ্ঠানের নাম।
ফায়ার সার্ভিস ও ডিপো সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্মার্ট গ্রুপের বিএম কনটেইনার ডিপোসহ অন্য সব ডিপোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে ত্রুটি। দাহ্য পদার্থ আমদানিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কড়াকড়ি নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো এখনো জ্বলছে। একটু পরপর কনটেইনারগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটছে। ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট কাজ করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার জন্য মালিকপক্ষের অবহেলা ও অনিয়মকে দায়ী করছেন অনেকে।
জানা যায়, বিএম কনটেইনার ডিপোটি চট্টগ্রাম ভিত্তিক স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালে নেদারল্যান্ডসের একটা ব্যবসায়ী গ্রুপের সাথে যৌথ মালিকানায় ডিপোটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর স্মার্ট গ্রুপের এমডি মজিবুর রহমান। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ।
জানা যায়, শুরু থেকেই এই বেসরকারি ডিপোর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিরাপত্তা ও যন্ত্রপাতির শর্ত পূরণ না করার কারণে ২০১৭ সালে ‘বিএম কনটেইনার ডিপো’র লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রেখেছিল কাস্টম কর্তৃপক্ষ। পরে নবায়নের সুযোগ পেলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হয়নি।
এছাড়া বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিনির্বাপণের জন্য ব্যবহৃত ‘ফায়ার ডিস্টিনগুইসারের’ মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে।
দুর্ঘটনার সময় ডিপোতে অবস্থান করা ট্রাক শ্রমিক মাহমুদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্যাজুয়াল নন-ক্যাজুয়াল তিনশোর অধিক শ্রমিক রয়েছে। এসব শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। ভেতরে অবস্থান করা ট্রাক শ্রমিকদের জন্যও কোন নির্দেশনা ছিলো না।
সোহেল নামের আরেক শ্রমিক জানান, ‘ডিপোর ভেতরে পানি সঞ্চালন লাইনেও ত্রুটি রয়েছে। আগুন লাগার সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে পানি সংগ্রহ করতে সময় লেগেছে বেশি।
এদিকে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পরও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। আগুন ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়লে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল থেকে কৌশলে সটকে পড়ে। যেকারণে ভোগান্তিতে পড়েন উদ্ধারকর্মীরা। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
রোববার সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আসা চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এই সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে বলেন, কাজের সুবিধার্থে কোথায় রপ্তানি পণ্য, কোথায় কেমিক্যাল পণ্য তা ফায়ার কর্মীদের দেখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ডিপোর লোকজন থাকার দরকার ছিল। অথচ এখানে এসে আমি কাউকে পায়নি। বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। তারা এখানে উপস্থিত থেকে ফায়ারের লোকজনকে গাইড করতে পারতো। আমি মালিকপক্ষকে আহবান করব আপনারা এসে সহযোগিতা করেন।’
তবে প্রতিষ্ঠানের এমডি মুজিবুর রহমান বলেন, কি কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কনটেইনার থেকেই আগুন ধরেছে বলে ধারণা করছি। এখন নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা হতাহতদের পাশে থাকবো।’
এদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুন লাগার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১০ কর্মী নিহত হয়েছেন। এছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের আরও ২১ জন কর্মী।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-সহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান শিকদার।
নিহত ১০ জনের মধ্যে মনিরুজ্জামান নামের একজনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তিনি কুমিরা ফায়ার স্টেশনে নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে আহতদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ। চিৎকার, কান্না আর আহাজারিতে ভারী পুরো হাসপাতাল। হাসপাতালের সামনে হতাহতের স্বজনদের নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে পুরো পরিবেশ।
খুলনা গেজেট/ আ হ আ