দেশের খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা দারুণভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার(১৭ মে) রাজধানীর নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন এ মন্তব্য করেন তিনি।
‘হাওড়ে বাঁধ নির্মানে কোটি কোটি টাকা লুটপাট-সর্বস্বান্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণ দাবিতে’ এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী কৃষকদল।
তিনি বলেন, আজকে কৃষি কাজ অলাভজনক হওয়াতে প্রান্তিক কৃষকেরা তো ছেড়ে চলেই গেছে ভিন্ন পেশায়। কেউ রিক্সা চালায়। কেউ ভ্যান চালায়। অন্য কৃষকেরাও কৃষি কাজ ছেড়ে দিচ্ছে, কারণ এটা এখন আর লাভজনক পেশা হচ্ছে না। আর ধান এখন আর লোকেরা আবাদ করতে চায় না। কারণ ধানে পয়সা নাই। ফলে তারা তরমুজ ও ভু্ট্টা করছে। ফলে খাদ্যশস্যে যে সিকিউরিটি (ফুড সিকিউরিটি) দারুনভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই হাওড়ের সমস্যা আজকে নতুন না। এটা বহু পুরনো সমস্যা। প্রায় প্রত্যেক বছরই পানি ঢল নেমে আসে। সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোন কর্মসূচি, পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। আর বর্তমানে সরকারের যেখানে সমস্যা, তারা সেই কাজগুলোই হাতে নেয়-যেখানে তাদের মুনাফা হয়, দুর্নীতি হয়, কমিশন পায় এবং তারা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বানাতে পারে।
দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকরা বিপর্যস্ত ও দিশেহারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা কৃষক পরিবারের সার্বিক অবস্থা খুবই নাজুক ও দুর্বিষহ। এর মধ্যে চলতি মওসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণাসহ কয়েকটি জেলার হাওড়ের লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে প্রান্তিক সেসব জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
তিনি বলেন, ‘হাওড় এলাকার সাড়ে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে কেবলমাত্র একটি ফসল হয়। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের কারণে কোন বছর সেটি তলিয়ে গেলে সারাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। হুমকিতে পড়ে জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’
ভারতের চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও সুরমা নদী দিয়ে ঢুকে পড়েছে উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, সুনামগঞ্জ জেলায় এ বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এ জেলায় পাহাড়ি ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে হাওড়ের বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি ঢলের পানির চাপে ভাটি এলাকার বাঁধও এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জে ১৯টি হাওড়ে বাঁধ ভেঙ্গে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার তাহিরপুর, শাল্লা, দিরাই, ধর্মপাশা, মধ্যনগর উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর জানিয়েছে এসব উপজেলায় ৫৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গিয়ে এপর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। আর নেত্রকোণায় মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টির কারণে খালিয়াজুরির ধনু নদীর পানিতে ডুবে গেছে প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল।’
চলতি বছরে সুনামগঞ্জ জেলায় বাঁধ নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ ছিল ১২২ কোটি টাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ৫ বছরে এই টাকার পরিমাণ ছিল ৬২১ কোটি টাকা। যা বাঁধ রক্ষায় তেমন কোন কাজে আসেনি। বরং এই বরাদ্দকৃত টাকা ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা এই টাকা হরিলুট করেছে।
‘যে সমস্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তা এতই দুর্বল যে, মাত্র ২৪ ঘন্টার পানির চাপ সামলাতে পারেনি। প্রতি বছর এভাবে বাঁধ নির্মাণের নামে হাওড় অঞ্চলে সরকারী অর্থ লুটের মহোৎসব চলে। এর ফলে কৃষকরা হয় সর্বস্বান্ত, অপরদিকে সরকারি দলের লোকজন ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা হয় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।’
বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে তেমন কোন উদ্যোগ বা তৎপরতা নেই মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলে জনগণের নিকট তাদের কোন জবাবদিহিতা নেই। তারা সবসময় ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে বলেই জনকল্যাণে কোন কাজ করে না। যার ফলে তাদের শাসনামলে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ সবসময়ই বঞ্চিত, অবহেলিত ও উপেক্ষিত থেকেছে।
এসময়ে সরকারি দুর্নীতিরোধ, হাওড়ের কৃষকদের দুর্দশা লাঘব ও শস্য নিরাপত্তা রক্ষায় ৮ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল।
সুপারিশগুলো হলো-হাওড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করে এই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে, বছর বছর বাঁধ নির্মাণ না করে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরীকৃত ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনা সুদে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, ঋণগ্রস্ত কৃষকের ঋণের সুদ মওকুফ এবং স্বাভাবিক অবস্থা না ফেরা পর্যন্ত ঋণের কিস্তি নেয়া বন্ধ করতে হবে।
‘হাওড় অঞ্চলে শস্য বীমা চালু করতে হবে, হাওড় অঞ্চলের কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য গণমূখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম, কৃষকদলের সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।