কুরবানি অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিজের সর্বাধিক প্রিয়বস্তু আল্লাহর রেজামন্দির জন্য উৎসর্গ করাই কুরবানির লক্ষ্য। বরং আল্লাহর রাহে নিজের জান-মাল ও কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ নিঃশঙ্কচে বিলিয়ে দেয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কুরবানি।
শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে মকবুল হবে না। দরকার হলো খালেছ নিয়ত। কারণ মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের কুরবানির গোশত ও রক্ত কোন কিছুই পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া বা আল্লাহভীতি (সূরা হজ: ৩)।
কুরবানি যাদের উপর ওয়াজিব:
প্রত্যেক সুস্থ জ্ঞানের অধিকারী, পূর্ণ বয়স্ক এবং মুকীম (মুসাফির নয়) ব্যাক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব যাদের কাছে ১০ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জ সন্ধা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ মাল আছে। তবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাবের মত সম্পদের মালিকানা এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং কুরবানির তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানি ওয়াজিব হবে। যাকাতের নেছাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাবপত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয় না, কিন্তু কুরবানির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র, সৌখিন দ্রব্যাদি, খালি ঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর তার জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এমন কিছুর মূল্যও হিসেবে ধরা হয়।
কুরবানির পশুতে আকীকা করা:
কুরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়ত করা যাবে। এতে কুরবানি ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে:
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়। যেসব পশু কুরবানি করা জায়েজ সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানি করা যায়।
কুরবানির পশু কেমন হবে:
কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানি জায়েয নয়। এমন দূর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয় । যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারাও কুরবানি করা জায়েয নয় । যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানি জায়েয নয়। যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানি জায়েয নয়। যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট সে পশু কুরবানি করা জায়েয নয়।
শরীক নির্বাচনে সতর্কতা:
শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানি সহীহ হবে না। যদি কেউ আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত করে কুরবানি করে তাহলে তার কুরবানি সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে।
পশু জবাইয়ের উত্তম তরীকা:
কুরবানির ছুরি অত্যন্ত ধারালো হতে হবে যাতে পশুর বেশী কষ্ট না হয়। এক পশুর সামনে অন্য পশুকে জবাই করা যাবে না, এতে পশু ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পশু সম্পূর্ণ না মরলে চামড়া ছিলা যাবে না। পশুকে জবাইয়ের আগে অনেকক্ষণ ধরে মাটিতে রেখে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া:
আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন, আল্লাহর নবী (স.) আমাকে তাঁর (কুরবানির উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দিব (বুখারী ও মুসলিম)। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।
জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে:
অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানি সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না।
কুরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ সাদকা করা:
কুরবানির চামড়া কুরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি।
পরিশেষে সকল পাঠকের প্রতি অনুরোধ যে, কুরবানি ও কুরবানির ঈদের সূক্ষ মাসয়ালা ও নিয়ম-কানুন জানার জন্য অবশ্যই কোন বিজ্ঞ আলেমের স্মরনাপন্ন হবেন। মহান আল্লাহপাক আমাদের কুরবানি ও কুরবানির ঈদকে কবুল করুন। আমীন।
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/ এস আই