আমি তাঁকে দেখেছি। বহুবার বহুরূপে বহুভাবে দেখেছি। কিন্তু এতবড় মানুষকে দেখলেই কি দেখেছি বলা যায়! অন্ধের হাতি দেখার মত আমি তাঁকে দেখেছি। আজ যা লিখবো তাও হবে অন্ধের হাতি দেখার মত বর্ণনা। এতবড় মানুষটাকে বর্ণনা করতে গেলে তার কাছাকাছি মানুষ হলে ভাল বর্ণনা হতে পারে। সেদিক বিবেচনায় আমি অতি নগন্য। তবু তাঁর মহাপ্রয়াণ দিনে কিছু বলে নিজেকে হালকা করতে চাই।
আমি তখন গাজীপুর থানার ওসি। হঠাৎ করে হুমায়ুন স্যার ফোন করে আমাকে নূহাশ পল্লীতে যেতে বললেন। বলার ভঙ্গি শুনে একটু সন্দেহ হলো। তাই মার্জিত স্বরে যাবার কারণ জানতে চাইলে তিনি সরাসরি বললেন, ” আমার পুলিশ বডিগার্ডকে এখনই এরেস্ট করে নিয়ে যান। কথাগুলো আমি আইজি সাহেব না বলে আপনাকে বললাম কারণ আমি শুনেছি আপনি ভাল মানুষ। ”
ফোন রেখেই আমি উর্ধতন অফিসারবৃন্দের কাছে বিষয়টি অবহিত করে নূহাশ পল্লীর দিকে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু নূহাশ পল্লী থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে থাকতে গাড়ি যাবার কোন উপায় না দেখে আমি ও আমার গানম্যান হাটতে শুরু করলাম। প্রচন্ড কর্দমাক্ত রাস্তায় পোশাক পরে হাটতে গিয়ে ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কিন্তু কয়েক কদম এগিয়ে দেখলাম একটি খালি রিক্সা উল্টো দিক থেকে আসছে।
গানম্যান বললো, ” এই রিক্সা, নূহাশ পল্লী যাবে? ”
“জী স্যার। আপনি কি ওসি সাহেব?” -রিক্সাওয়ালা বললো।
গানম্যান- “একটা রিক্সায় তোমরা দুইজন কি কর ”
“স্যার, একজন টানি, আর একজন পিছন দিয়ে ঠেলি। এত কাদার ভিতর এই ছাড়া নূহাশ পল্লী যাওয়া যাবেনা ”
সেই রিক্সায় একজনে টেনে আর একজনে পিছন থেকে ঠেলে আমাদেরকে নূহাশ পল্লীতে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম পেশাগত কারণে তা আর বলতে চাইনা।
পরিচয়ের সূত্র তিক্ত হলেও মিষ্টি হতে একটুও সময় নষ্ট করতে হয়নি। মোটামুটি আধা ঘন্টা সময়ের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেল। স্যারের গানম্যানকে এরেস্ট করা লাগলো না। বরং স্যার খুশি হয়ে দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করিয়ে ছাড়লেন। খাবার সময় বললেন,” আমি আইজি সাহেবকে বলবো – দেশের সব থানায় যেন আপনার মত ওসি দেয়। ”
পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সাথে যোগাযোগ ছিল। আমেরিকায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে তাঁর সহধর্মিণীর মাধ্যমে কথা হতো। তাঁর সাথে আমার শেষ কথাগুলো এখনও কানে বাজে।
আমি তখন জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সুদানে কর্মরত ছিলাম। স্যারের অসুস্থতার খবর আমি জানতাম। তাই প্রায়ই শাওন ম্যামের মাধ্যমে খোঁজ খবর নিতাম। কিন্তু ডাক্তারের নিষেধ থাকায় ও মোবাইলের কাছে না পাওয়ায় স্যারের সাথে সরাসরি কথা বলা যেতো না। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমার মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে পড়লো। বার বার শাওন ম্যামকে কল করতে থাকলাম। তিনিও আমাকে কথা বলানোর চেষ্টা করছিলেন। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর স্যারের হাতে মোবাইল দেবার পর আমার কোন কথা না শুনেই তিনি একদমে আমাকে কিছু কথা বললেন। সেই কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন – “ভাই, ভাই আমার জন্য দোয়া করেন। বেঁচে থাকলে দেখা হবে
এই সহজ কথাগুলো আমি আজও শুনতে পাই। আমার কানে মাঝে মাঝে সেই মায়াবি শব্দগুলো এখনও বেজে ওঠে। তিনি আমাকে এমনভাবে কথাগুলো বলেছিলেন যা আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত কয়েক দিনের মধ্যেই আমার সেই ভাবিয়ে তোলা কথাগুলো বাস্তবে রূপ নিলো। সারা দেশের মানুষকে অকুলে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন এক বর্ষাদিনে।
আমি সুদানে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে থেকে খবর শুনে ভীষণ মর্মাহত হলাম। ভাবলাম স্যারের মরদেহ ছুঁয়ে দেখার ভাগ্য আমার নেই। কিন্তু আল্লাহর খেলা বুঝা বড় দায়। হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে জরুরী বার্তা পেয়ে আমাকে দেশে আসতে হলো। ডবল দামে এয়ার টিকিট করে দেশে এলাম। তার দুই দিন পর আমেরিকা থেকে স্যারের মরদেহ দেশে এলো। জাতীয় শহীদ মিনারে স্যারের মরদেহের কফিন দেখতে আসা লক্ষ মানুষের সাথে আমিও এক পলক দেখে নিলাম।
দুদিন পর আবার নূহাশ পল্লীতে গেলাম। সেদিনও প্রচুর বৃষ্টি ছিল। মনের মাঝে স্যারের লেখা সেই গানটি বার বার বেজে উঠছিল।
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো এক বরষায়।
নূহাশ পল্লীর সদর গেট তখন বন্ধ ছিল। বাইরে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের ভিড়ে ভাওয়াল এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়েছিল। গত দুইদিন হূমায়ুন আহমেদের সমাধি দেখতে আসা মানুষের ভিড়ে নূহাশ পল্লীর লালিত ঘাস, ছোট ছোট কিছু গাছ আর ফুলের বাগান মানুষের পায়ে দলে কাদায় কাদায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাই কতৃপক্ষের নির্দেশে নূহাশ পল্লী বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মানুষের ভালবাসার ঢল ঠেকায় কে!
আমি উপস্থিত হাজারো ভক্তের সাথে কথা বললাম। তারা দূর দূরান্ত থেকে প্রিয় মানুষের সমাধি এক নজর দেখতে এসে বিফল হয়ে ফিরে যেতে নারাজ। বাধ্য হয়ে নূহাশ পল্লীর দায়িত্বরত বুলবুল সাহেবকে মোবাইল করলাম। তিনি ভিতরেই ছিলেন। আমার ফোন পেয়ে দৌড়ে এলেন। আমি আমার গাড়ি নিয়ে একাই ভিতরে যাবার অনুমতি পেলাম। কিন্তু বাইরে অপেক্ষমান সবার মুখের দিকে চেয়ে একা ঢুকতে মন সায় দিলো না। তাই বুলবুলকে বলে সবাইকে ভিতরে যাবার অনুমতি নিলাম। মূহুর্তের মধ্যে সমগ্র নূহাশ পল্লী লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।
হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সাথে আমার জীবনের অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এক এক করে স্মৃতিচারণ করলে শেষ করা কঠিন হবে। শুধু দুই একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
তিনি আমাকে হঠাৎ হঠাৎ কল করতেন। একদিন কল করে বললেন,” এখনই নূহাশ পল্লী আসতে হবে।” আমি জানতাম – তাঁর কথা ফেলা যাবে না। অতএব হুকুম মোতাবেক হাজির হলাম। তিনি আমাকে গাছ তলায় একটি চেয়ারে বসতে দিলেন। সাথে সাথে চা বিক্রেতার সাজে বিচিত্র পোশাক পরে তিন প্রখ্যাত অভিনেতা ডাঃ ইজাজ, ফারুক ও স্বাধীন খসরু আমাকে একসাথে স্যালুট দিয়ে ফ্লাক্স থেকে এক কাপ চা ঢেলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। স্যার বললেন, ” কি ব্যাপার, বসে আছেন কেন?”
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে স্যার আবার বললেন, ” আপনাকে অভিনয় করতে হবে। ”
কি অভিনয়, কি চরিত্র, সংলাপ কি। এসব কিছুই আমাকে আগে বলে দেননি।
স্যার বললেন, “একজন আপনাকে ছালাম দিলে অন্ততঃ ছালামের উত্তর দিবেন তো।”
অতঃপর সেই তিন চা ওয়ালা আবার একইভাবে আমাকে ছালাম দিয়ে দাঁড়ালেন। আমি ছালামের উত্তর দিলাম। তারা ডায়লগ শুরু করলেন। আমাকে আমার ডায়লগ বলে দিলেন স্যার নিজেই। কোন স্ক্রিপ্ট নেই।
তারপর স্যার মাথা নেড়ে বললেন, “হবে। চলেন খেয়ে আসি। ”
আমি বললাম – আমার স্ক্রিপ্ট কোথায়, কি চরিত্র?
স্যার বললেন, ” আপনি যা, সেই চরিত্র। অতএব স্ক্রিপ্ট লাগবে না। খেয়ে এসে মূল স্যুটিং হবে। আপনার বডিগার্ডও অভিনয় করবে। ”
যথারীতি খাবার পর স্যুটিং হলো। অভিনয় শেষে আমাকে ও আমার বডিগার্ডকে আলাদা আলাদা খামে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন। আমি যতবার ফিরিয়ে দিলাম তিনি তার চেয়ে বেশি জোর করে আমাদের টাকা নিতে বাধ্য করলেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, বিনা সম্মানিতে কোনদিন কারো কাছ থেকে কিছু নিলে তাতে অকল্যাণ হয়।
এরপর বহুবার তিনি আমাকে নাটকের জন্য ডেকেছেন। সময়ের অভাবে আমি তাঁর ডাকে সব সময় সাড়া দিতে পারিনি। শুধু আর একবার অন্য একটি নাটকে সামান্য সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। এর মাঝে তিনি আমাকে বহুবার চাকরি ছেড়ে তাঁর সাথে কাজ করার জন্য বলেছিলেন।
একদিন হঠাৎ তিনি ফোন করে ‘নলিনী বাবু বিএসসি’ নামে তাঁর লেখা সদ্য প্রকাশিত একটি বইয়ের পাতা উল্লেখ করে পড়তে বললেন। আমি তার মর্ম বুঝিনি তাই ভুলে গিয়েছিলাম। পরদিন আমার বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন বই পড়ুয়া জয়েন্ট সেক্রেটারি নিখিল রঞ্জন মন্ডল স্যার আমাকে ফোন করে বললেন, ” হূমায়ুন আহমেদ তার লেখা নতুন বই নলিনী বাবু বিএসসি বইতে আপনার কথা লিখেছেন “।
ইতিমধ্যে হুমায়ুন স্যার সেই বইটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি পড়ার পর রীতিমত অবাক হলাম। আবার তাঁকে ফোন করে আমার নাম দিয়ে লেখার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন,” আমি সারাজীবন আমার বই, সিনেমা, নাটক যেখানে পুলিশের চরিত্র লিখবো সেই পুলিশকে যদি ভাল বানাই তাহলে নাম দিবো কামরুল। ” আমি শুনে অবাক হলাম, খুশিও হলাম। এর প্রমাণ বহুবার পেয়েছি। একদিন প্রাক্তন আইজিপি ও তত্ত্বাবোধক সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব আনোয়ারুল ইকবাল স্যার আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, হূমায়ুন আহমেদের নাটকে বা সিনেমায় তিনি পুলিশের ভূমিকায় কামরুল নাম দেখেছেন। আমার মত মানুষকে এভাবে মূল্যায়ণ করায় আমি মনে মনে দারুণ খুশি হতাম।
এ ছাড়াও অনেক কথা মনে পড়ে। তিনি স্বপরিবারে আমার গ্রামের আয়োজিত সোনামুখ বিজয় মেলায় অতিথি হয়ে আসতে চেয়ে ছেলের অসুস্থতার জন্য আসতে পারেননি। আমার এই না পাওয়ার কষ্ট চিরদিন রয়ে যাবে। আমার কষ্ট সামান্য লাঘব করতে সোনামুখ পরিবার বিএল কলেজ রোড শাখায় তাঁর নামে গড়ে তোলা হয়েছে “সোনামুখ হূমায়ুন আহমেদ স্মৃতি গ্রন্থাগার” । এই গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করেন হুমায়ুন আহমেদের সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন, তাঁর ছেলে নিষাদ ও নিনিত।
তাঁর বিদায় তিথিতে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এই ক্ষণজন্মা মানুষটির উপর আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।
১৯.০৭.২০২০