১.
পড়ন্ত বিকেলে পুকুরপাড়ে বসে
আনমনে দেখেছো কি কখনো হঠাৎ
অজস্র তরঙ্গের একইসাথে আন্দোলিত হয়ে ওঠা?
কিংবা শুনেছো কি কখনো হঠাৎ
তোমায় দেয়া ডাকের মাঝে
সন্তর্পণে লুকিয়ে থাকা অনুচ্চারিত শব্দমালা?
আকাশের ওই চাঁদোয়ার কোলে মেঘেরা ভিড় জমালে কি কেঁপে ওঠে না তোমার হৃৎপিণ্ড?
নাকি অনুভূতিরা ঘন হয়ে উঠেও আবার হয়ে রয় নির্লিপ্ত!
দেখো বাতাসে বর্ষা আর বেলিফুলের ঘ্রাণ কেমন নিবিড় হয়ে প্রবেশ করতে চায় নাসিকায়;
কিন্তু তবুও কি তুমি বুঝবে না ওই বর্ষার সুর আর বেলিফুলের শুভ্রতার গভীরতর অনুনয়?
যদি তুমি ভেবে থাকো যে আমি অপরিস্ফুটিত গোলাপের পাপড়িতেই মোহময় সুরভি খুঁজে ফিরব;
তবে ভুল ভেবেছো তুমি!
বরং আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব
তার পরিপূর্ণ পরিস্ফুটনের জন্য।
হয়তোবা এতে সম্মুখীন হতে হবে হাজারো কারসাজির;
তবু তোমার জন্য আমি বসন্তের পর বসন্ত পার করতে রাজি।
২.
সূর্যমূখির বুকে বসে
তিতলি কতো গান লেখে;
প্রবহমান ঝরনার ধারা ফেলে আসা
নিলার কথা কী মনে রাখে?
বসন্ত যায়, আবার বসন্ত আসে।
কিন্তু উড়ন্ত মন ডুবন্ত হয়ে আবার দূরন্ত হয়ে ফিরে এসে
তড়পায় জমাট বাঁধা আঁধারের জঠরে!
তবু আলোকছটার আগমন ঘটে পুবাকাশে।
মাতাল দখিনা সমীরণ আসে নব উল্লাসে;
প্রেয়সীর করতলের কোমল ভাঁজে ডুব দেয় দ্রুতিসম্পন্ন ডলফিনের ন্যায়
কিংবা সমুদ্রের স্বচ্ছ ঢেউয়ের ওষ্ঠে পূর্ণিমা এঁকে দেয় পাঁচশত ত্রিশটি উষ্ণতম চুম্বন!
এরপরও যদি কোনো গোধূলি বেলায়
তুমি শায়িত হয়ে থাকো বিছানায় উপুড় হয়ে
ঈষৎ রিক্ত, ঈষৎ বিষণ্ন হয়ে
আর করতে থাকো তোমার বাগিচার
নতুন চারা কিনবার তালিকা;
তখন হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে রংধনুর সপ্তরং বিচ্ছুরিত হবে
আর একটি খাম পৌঁছে যাবে তোমার কাছে আনিকা;
অতঃপর সবিস্ময়ে তা খুললে
খুঁজে পাবে একখানা ভেজা চিঠি আর চাঁদহীন রাতের একটি সন্ধ্যাতারকা!
৩.
কোনো এক অতীতের খাল হতে
ঝাঁকে ঝাঁকে স্মৃতির ট্যাংরা সাঁতরে আসছে
বর্তমানের নদীতে
আর আকাশে মেঘেরা কাতরাচ্ছে প্রসব-ব্যথায়
যেন এখনই ভূমিষ্ঠ হবে শত শত বজ্রশিশু!
তবু এর মাঝেই এসো না তুমি আমার গৃহে;
অভিধান হতে শব্দ চুরি করে কবিতায় তোমার উপমা দেওয়া ছাড়া
তোমায় তো আমি দিতেই পারব না কিছু!
তার চেয়ে বরং যেদিন আমি দিব তোমায় সোনার দিনার
আর যুগপৎভাবে ছুঁব আমরা ‘সোনালি কাবিন’
সেদিন ভেঙে যাবে সব বাধার মিনার;
পাবে তুমি আর আমিও পেয়ে যাব সোনার হরিণ!
সেদিন বলব তোমায় খোলো তোমার কৃষ্ণ কেশের দৃঢ় বাঁধন,
সুরভি ছড়িয়ে তা ছুঁয়ে যাক তোমার জঘন
আর দারুণ শিহরণ বয়ে গিয়ে আমি হই পাগলপারা;
যদিও এতদিন ‘তাজকিয়াতুন নফস’-ই ছিল আমার অবলম্বন!
কিন্তু এসব কথা আমার কল্পনার সানুদেশে
ছুটে বেড়ায় পাহাড়ি বল্গা হরিণ হয়ে।
তবু মধ্যরাতের ঝাপসা স্বপ্নের মাঝে তুমি এলে
দিই তোমার চুলে জোনাকির কিছু লুসিফেরিন ছড়িয়ে!
৪.
ভাবনার দেহ থেকে আবেগের আগল খুলে গিয়ে
শুধু রয়ে যায় বিবেকের শিকল:
সেই শিকলের গায়ে আবার মরিচা কেন পড়ে
দুঃস্বপ্নের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয় রজনী দীঘল?
আসলে কিছু কিছু ঘটনাকে জীবন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয় বটে
কিন্তু স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব না!
তাই কিছু কিছু বস্তু বা ব্যক্তিকে ভালবাসতে না পারলেও
কখনোই ঘৃণা করা সম্ভব না!
অবশ্য আমি তো এখন আর ‘ভালবাসা’কে ভালবাসি না
আর না পারি ‘ঘৃণা’কে ঘৃণা করতে!
সমগ্র চেতনা আমার ভরে থাকে এখন তাই দ্বিধাহীন কর্মপন্থার সমৃদ্ধ সম্ভারে।
বিনিদ্র রজনীতে আমি যখন সম্পূর্ণ
করতে বসি কয়েকটি অসম্পূর্ণ শ্লোক;
তখন বিবমিষায় কাতর কোনো এক বোনের মতো
যেন কেঁপে ওঠে আমার পবিত্র ক্রোধের গোলক!
আমি এখন ভুলে গিয়েছি কে আমার স্বপ্নে এসে
পাঁচশত ত্রিশটি চুম্বনের আবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল
কিংবা ক্যালেন্ডারের কোনো এক পাতাকে
করে দিয়েছিল দারুণ কাতরতাময়!
সুতরাং কেউ যদি আমার পরিত্রাতা হয়ে থাকে তবে সে হলো আমার এই– বিস্মৃতির মেলাই!
৫.
পরিশেষে বিস্মৃতির মেলা থেকে কিছু কিনে আনার জন্যে
যখন রওনা হয়ে যাই আমার পুরানা নীল জুতো পরে;
উদ্ভিন্ন ঘৃতকুমারীর সুরভি ছড়িয়ে তখন কার কুন্তলের ঝাপটা
এসে লাগে আমার চেহারাতে!
কিন্তু আমি তো আর তাঁর দিকে কিছুতেই চোখ ফেরাব না
আর না আকুল হয়ে বাস্তবের পাশাপাশি কল্পনাতেও তাঁর কোমল আঙুল ছুঁতে হাত বাড়াব!
শীতের নরম রোদ কখনো নরম থাকে কি গ্রীষ্মের দিনে?
কিংবা পাওয়া যায় কি তাকে খুঁজে বর্ষার মেঘপুঞ্জের সামনে?
এজন্যই তো আমরা এতো বসন্ত বসন্ত বলে চিৎকার করতে করতে শরৎকে অবহেলা করে ফেলি অনেকটা!
মূলত তো সব ঋতুর মাঝেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে সৌন্দর্যের ইনসাফ,
যদিও আমরা প্রতিটা মুহূর্তে তা করতে পারি না অনুধাবন!
তাহলে কী লাভ বলো মায়ের হাতে ভুনা করা গো-মগজ খেয়ে
তার ভূয়সী প্রশংসা করে–
যখন তোমার নিজের মগজই হয়ে গেছে ভুনা
স্বার্থপরতার রংচটা লোহার পাতিলে?
৬.
প্রয়োজনের খাতিরেই তো মানুষের সাথে গড়ে ওঠে সখ্যতা;
কিন্তু মূলকথা তো হওয়ার ছিল– সখ্যতা গড়ে উঠবার পরই অপরের প্রয়োজনে তাঁর পাশে দাঁড়ায় মানুষ।
আসলে মানুষের প্রয়োজনাবলীর কোনো একক দেশ থাকে না;– যার মানচিত্র আঁকা সম্ভব!
এমনকি আমরা তো আমাদের জানালার শিকে এসে বসা
ছোট চড়ুইয়ের কাছেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও সুর প্রার্থনা করি
কিংবা চাই আমাদের কষ্টের কথা আরেকজনকে শুনিয়ে কিছু সান্ত্বনা শুষে নিতে তার হৃৎপিণ্ড থেকে!
যদিও আমরা সেই চড়ুই বা ব্যক্তির অনুভূতি সম্পর্কে থেকে যাই অনবহিত।
অতঃপর আবার আমরা আমাদের শিক হতে চড়ুই তাড়াতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি
যেন সেই চড়ুই আবার আমাদের রুমে ঢুকে
আমাদের দানাপানির দিকে নজর না দেয়
আর সান্ত্বনাদাতার সাথেও বজায় রাখি দূরত্ব
যেন তাকেই সান্ত্বনা দেবার দায়িত্ব আবার
আমাদের ওপর না বর্তায়!
ভীরুদের ভীরুতার কাব্যকথা এভাবে লিখতে লিখতেই তো জীবন ফুরাতে চললো;
আর কতোকাল লিখতে হবে বলো আমাকে এভাবেই ভীরুদের সাহসী করে তুলবার জাগরণী শ্লোক?