করোনা ভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন খাত। টানা ৫ মাস ধরে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের যাতায়াত নেই বনে। এ অবস্থায় পর্যটক শুন্য সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থান সমূহে এখন বিরাজ করছে সুনশান নিরবতা। আর ম্যানগ্রোভ এ বনাঞ্চলকে ঘিরে গড়ে ওঠা ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লঞ্চ, ট্যুর বোট ও ট্রলার সহ সহস্রাধিক নৌযান পার করছে অলস সময় । এতে বেকার হয়ে পড়েছেন এ সকল নৌযানের কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী । অপরদিকে এ অবস্থা অব্যাহত থাকায় পর্যটন খাতে বন বিভাগের রাজস্ব আয়েও ভাটা পড়েছে।
বন বিভাগের সূত্র মতে, অপরুপ সৈন্দয্যের লিলাভুমি বিশ্বের একক ম্যানগ্রেভ বন সন্দরবন। ‘১৮৭৫ সাল থেকে সংরক্ষিত’ সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা (ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড) সংরক্ষিত সুন্দরবন প্রান-প্রকৃতির আধার। বাংলাদেশের সমগ্র বনাঞ্চলের অর্ধেকের বেশী হচ্ছে সুন্দরবন। সুন্দরবনে বাংলাদেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়াবী হরিন, কিং-কোবরা, বানর, গুইসাপ সহ প্রায় ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও সরিসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর সহ ৩২০ প্রজাতির বন্য প্রানীর বসবাস। সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, গরান, ধুন্দল, গোলপাতা সহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এ বনে।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদী ও খালে রয়েছে বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতী সহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, লবণ পানির কুমির ও ৪০০ প্রজাতির মাছ। প্রকৃতির নৈসর্গিক এ বনাঞ্চলকে ঘিরে দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদের রয়েছে নানা কৌতুহল। তাই প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসেন এ বনে। প্রাণ-প্রকৃতির নির্ভেজাল বাতাসে স্বস্তির নিস্বাস কিংবা দৃষ্টি নন্দিত জীব বৈচিত্র্যের মাঝে একটু আনন্দ খুঁজে নিতে। সুন্দরবনের করমজল, কটকা, কচিখালী, হারবাড়িয়া, হিরনপয়েন্ট, দুবলা, আলোরকোল ও নীলকমল সহ সমুদ্র তীরবর্তী এবং বনাঞ্চলের ছোট ছোট নদী-খালের জলরাশিতে লঞ্চ, ট্যুর বোট, ট্রলার ও বিভিন্ন নৌযানে চড়ে বছর জুড়েই যাতায়াত দর্শনার্থীদের। আর সুন্দরবনের এ পর্যটন খাতকে ঘিরে মোংলা সহ আশপাশের এলাকায় কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে হাজারও মানুষের। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মহামারীতে হঠাৎ সব কিছুই যেন থমকে যায়।
গত ২৫ মার্চ থেকে সুন্দরবনের পর্যটকদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাঞ্জা জারি করে বন বিভাগ। তাই ট্যুর লঞ্চ, জালিবোট, ট্রলার ও নৌকাসহ ২ হাজার নৌযান এখন অলস সময় পার করছে। এতে ইঞ্জিন বিকল সহ ঘাটেই নষ্ট হতে বসেছে অধিকাংশ ট্যুর নৌযান। একই সঙ্গে এ খাতে জড়িত ব্যবসায়ীরা এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
অপরদিকে পর্যটকদের যাতায়াত না থাকায় দর্শনীয় স্থান সমূহের পন্টুন, কাঠের পুল ভেঙ্গে পড়ছে। খসে পড়ছে বিভিন্ন স্থাপনা। আর এ নিয়ে তেমন নজরদারীও নেই বন বিভাগের।
এ বিষয় সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা মোঃ আজাদ কবির হাওলাদার জানান, পর্যটন কেন্দ্রের স্থাপনা, পন্টুন ও পুল সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়ে বন বিভাগের উপরি মহলে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
মোংলাস্থ ‘দ্যা সাউদার্ন ট্যুর এ্যান্ড ট্রাভেলসের’ স্বাত্বাধিকারী মোঃ মিজানুর রহমান জানান, বন বিভাগের এ নিষেধাঞ্জা টানা ৫ মাস ধরে বলবৎ থাকায় একদিকে যেমন পর্যটন খাতে বন বিভাগের রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়েছে। অপরদিকে পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে মোংলা সহ আশপাশের এলাকায় গঠে ওঠা হোটেল, মোটেল এবং বন কেন্দ্রিক কটেজ সমূহ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এতে চরম দূর্ভোগ আর দূর্দশার মধ্যে পড়েছেন পর্যটক পরিবহনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন নৌযানের মালিক ও শ্রমিক-কর্মচারী সহ কয়েক হাজার পরিবার। বিগত বছরগুলোতে সুন্দরবনে পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগে গড়ে ২ লাখ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সমাগম ঘটে। আর বছরে গড় রাজস্ব আয়ও ২ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে থাকে।
এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘পর্যটন খাতে রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ অর্জিত হয় পূর্ববন বিভাগ থেকে। কিন্তু বনবিভাগের এ অংশে গত জানুয়ারী ও ফ্রেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত দর্শনার্থী নির্ভর কিছুটা আয় হলেও এপ্রিল থেকে আগষ্ট পর্যন্ত ৫ মাসে বনবিভাগের রাজস্ব আয় শুণ্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সুন্দরবনের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোঃ মঈনুদ্দিন খাঁন জানান, বন,পরিবেশ ও জলবায়ু বিষায়ক মন্ত্রানালয়ের সিদ্ধান্তে আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত সুন্দরবনের পর্যটন খাত বন্ধ রাখা হয়েছে। কবে নাগাদ আবারও সুন্দরবনে পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি বনবিভাগের এ কর্মকর্তা।
এ বিষয় সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড.শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সীমিত আকারে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প পরীক্ষামুলকভাবে খুলে দেয়া যেতে পারে। এতে পর্যটন শিল্পের অর্থনীতিতে গতি ফিরবে এবং দীর্ঘদিন বেকার থাকা মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আর এখনই বনাঞ্চলের দর্শনীয় স্পট সমূহ উম্মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ।
খুলনা গেজেট/এমবিএইচ