নতুন একটি নাম একটি মাত্র শব্দ “করোনা”। করোনা একটি বিশ্বব্যাপি সমস্যা। আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এর সুদুর প্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এর যাতাকলে বহুদিন আমাদের নিষ্পেসিত হতে হবে। তবে এর শেষ কোথায় তা কেউ এই মুহূর্তে বলতে পারছে না। তবে তার আগে এই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে একটু জেনে আসি।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহার শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির লক্ষণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে COVID নামকরণ করে। করোনা ভাইরাস বলতে ভাইরাসের একটি শ্রেণীকে বোঝায় যেগুলি স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিদের আক্রমণ করে। মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। এই সংক্রমণের লক্ষণ মৃদু হতে পারে, অনেক সময় যা সর্দি কাশির ন্যায় মনে হয়। কিছু ক্ষেত্রে তা অন্যান্য মারাত্মক ভাইরাসের জন্য হয়ে থাকে, যেমন সার্স, মার্স ও কোভিড-১৯। অন্যান্য প্রজাতিতে এর তারতম্য দেখা যায়। তবে মানবদেহে সৃষ্ট করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানোর কোনো টিকা বা এন্টি ভাইরাল ওষুধ আজও আবিস্কার হয়নি। তবে বিভিন্নভাবে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে টিকা আবিষ্কারের। তবে আমরা আশাবাদী অচিরেই প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের সংবাদ পেয়ে যাবো।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির কথা জানা যায় ৮ মার্চ ২০২০ এবং প্রথম মৃত্যু ঘটে এ বছরের ১৮ মার্চ।
করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার কথা নিয়ে সরকার ১৭ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। করোনার বিস্তার রোধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সীমিত এবং প্রায় সব শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্ট কালে জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত সারা বিশ্বের শিক্ষা কার্যক্রম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এই অবস্থায় শিক্ষা নিয়ে কোন পরিকল্পনার কথাও শোনা যায় না। অনেকেই ভাবছেন, জীবন বাঁচানোর কার্যক্রম যেখানে পর্যাপ্ত নয়, সেখানে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা কতটা যৌক্তিক। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে জীবন বাঁচানোর জন্যই। শিক্ষাকে বাদ দিয়ে আমরা আগামির করোনামুক্ত পৃথিবী খুঁজে পাবো না, কখনও তা সম্ভবও না। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে আমাদের সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
করোনকালীন সময়ে শিক্ষা নিয়ে যখন চরম হতাশা বিরাজ করছে ঠিক তখন ইউসেপ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন যা পরবর্তী সময়ে করোনাকালীন শিক্ষায় রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
করোনার দীর্ঘসূত্রিতা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে ইউসেপ শিক্ষকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও কর্তৃপক্ষের পরামর্শে শিক্ষকগণ ইউসেপ স্কুলে অধ্যয়নরত সকল শিক্ষার্থীর সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও Phycho Social Counselling প্রদানসহ নিয়মিত লেখাপড়া করার পরামর্শ প্রদান, মোবাইলে পড়া দেয়া নেয়া এবং বিটিভি প্রচারিত অনলাইন ক্লাশ দেখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এই প্রক্রিয়ায় মোবাইল ট্রাকিং এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সাথে সপ্তাহে অন্তত একবার যোগাযোগ করা হয়।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরী করে আপলোড করা হয় এবং পরবর্তীতে তার ভিত্তিতে নিয়মিত মূল্যায়ন করা হয়। এছাড়াও সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও সাজেশন তৈরি করে তা সরবরাহ করা হয়।
পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি না হওয়ায় এবং করোনার ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এবং শেণীকক্ষে শিক্ষাদানের চিন্তা বাদ দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিটিভি প্রচারিত পাঠদান চলমান রাখার পাশাপাশি অনলাইনভিত্তিক প্লাটফর্মের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক মূল্যায়ন ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বর্তমান শ্রেণীর প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। এছাড়া অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীর সুযোগ থাকার ফলে এক বিশাল জনগোষ্ঠি শিক্ষা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছে।
কিন্তু ইউসেপ বাংলাদেশ সকল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ইউসেপ ষ্টাডি সেন্টার মডেল চালু করে। যা করোনাকালীন শিক্ষা ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইউসেপের ষ্টাডি সেন্টারে সপ্তাহে একদিন দলনেতার নেতৃত্বে ও শিক্ষকের তত্বাবধানে আন্তব্যক্তিক যোগাযোগ, মতবিনিময় ও বাড়ির কাজ দেয়া নেয়া সম্পন্ন করছে।
বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ষ্টাডি সেন্টারে শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃক প্রেরিত ও ইউসেপের ডিজাইনকৃত এসাইনমেন্ট শিক্ষকদের সহায়তায় সম্পন্ন করছে।
ইউসেপ ষ্টাডি সেন্টার মডেল ইতিমধ্যে কমিউনিটিতে বেশ সাড়া ফেলেছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরী হয়েছে। তারা এখন ষ্টাডি সেন্টার ও বাসায় বসে নিয়মিত এসাইনমেন্ট তৈরি করে জমা দিচ্ছে। অভিভাবকরাও এহেন পরিস্থিতে খুব খুশি কারণ ছেলেমেয়েরা দিনের কিছু সময় লেখাপড়ায় ব্যয় করছে।
নিকট ভবিষ্যতে করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূণরায় খোলা বিলম্বিত হলেও ইউসেপ ষ্টাডি সেন্টার করোনাকালীন শিক্ষায় আরও কার্যকর ফলাফল বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করছি। ইউসেপ এর আলোবর্তিকা ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশে-এই কামনায় শেষ করছি।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, ইউসেপ ওয়াজেদ আলী স্কুল, বানরগাতি, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এনএম/এমএম