সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীসিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে তাদের কক্সবাজার জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নির্ধারিত পোশাক পরিয়ে অন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মতোই তাদের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে।
শহরের বাইপাস সড়কের উত্তরে অবস্থিত এই কারাগারটি। ৫৬০ জন ধারণক্ষমতা হলেও এই কারাগারে বর্তমানে কয়েদি রয়েছেন প্রায় সাড়ে চার হাজার।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. নেছার আলম বলেন, ‘নিয়মান অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলীকে কারাগারের সাধারণ সেল থেকে সরিয়ে নির্ধারিত পোশাক পরিয়ে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে।’
জেল সুপার আরও বলেন, ‘কক্সবাজার জেলা কারাগারে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য আলাদা কোনো কনডেম সেল নেই। এই কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এলে কিছু কক্ষকে কনডেম সেল ঘোষণা করে সেখানে রাখা হয়। জেল কোড অনুযায়ী তাদের প্রতিদিন খাবার ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। কারাগারের অন্য বন্দিদের মতো তাদের খেতে দেওয়া হয় সাদা ভাত, মাছ ও সবজি।’
নেছার আলম আরও বলেন, ‘অন্য সেলের তুলনায় কনডেমড সেল আকারে ছোট। সেলের ভেতর আলো-বাতাস তেমন থাকে না। তবে দিনের নির্দিষ্ট সময় আসামিদের সেলের বাইরে হাঁটাচলার সুযোগ দেওয়া হয়। কনডেমড সেলের আসামিরা মাসে এক দিন জেলগেটে গিয়ে দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান।’
জেল সুপার বলেন, ‘সিনহা হত্যা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি কয়েদি হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে তাদের অন্য কয়েদিদের সঙ্গে সেলে রাখা হবে। একই সঙ্গে খালাস পাওয়া আসামিদের বিষয়ে আদালতের কাগজপত্র এলে মুক্তি দেওয়া হবে।’
যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, তারা হলেন টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব, পুলিশের সোর্স কক্সবাজারের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিন। এছাড়া এপিবিএনের তিন সদস্যসহ ৭ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
এর আগে সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণার সময় এজলাসে নির্বিকার ছিলেন আসামি প্রদীপ ও লিয়াকত। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় দেন। এদিন সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। প্রদীপসহ আসামিদের প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় উৎসুক জনতা চিৎকার করতে থাকে। আসামিদের নিয়ে যাওয়ার সময় আদালত প্রাঙ্গণে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাদের স্বজনেরা। দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে এসে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর মামলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেন বিচারক। এরপর শুরু পর্যবেক্ষণ জানান আদালত ।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত বিতর্কিত বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমারসহ ১৫ আসামিদের আদালতে আনা হয়। সোমবার দুপুর ২টায় প্রিজনভ্যান থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে তাদের নামানো হয়। রায়কে কেন্দ্র করে আদালতের চতুর্পাশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এসব মামলা দায়ের হয়। টেকনাফ থানায় দায়ের করা দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা মামলাটিতে আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সফরসঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। মামলার অন্য আসামিরা হল, টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরিদর্শক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।
মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র্যাবকে। একইসঙ্গে পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটিও র্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত।
২০২০ সালের ৬ আগস্ট সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র্যাবকে হস্তান্তর করা হয়। ওইদিন বিকালে মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল-এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিল না। ওইদিনই আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১৩ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেইসঙ্গে পুলিশের দায়ের তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন আদালত।
এরপর মামলাটি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ২০২১ সালের ২৪ জুন পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এতে আদালত ওইদিনই তাকে কারাগারে প্রেরণ করার আদেশ দেন।
২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। একইসঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
খুলনা গেজেট/এনএম