৪ ডিসেম্বর, খুলনা বেতারের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭০ সালের আজকের এই দিনে সামান্য ক’জনকর্মী নিয়ে, খুলনাবাসীকে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্র। ঐতিহ্যে, আধুনিকতায় এ অভিযাত্রার প্রতিটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের শ্রোতাদের সাথে খুলনা বেতার গড়েছে হৃদয়ের সেতুবন্ধন। শুরু থেকে এ পর্যন্ত বহু সংখ্যক নতুন ধারণার অনুষ্ঠান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছে। অনেক অনুষ্ঠান যুগের পর যুগ পেরিয়ে এখনও চলছে শ্রোতাদের ভাললাগা-ভালবাসায়। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে আসছে বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্র।
২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সে লক্ষ্যেই সারাদেশের মত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নকর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের নানাবিধ কর্মসূচির সঠিক তথ্য তুলে ধরে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নে খুলনা বেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে খুলনা বেতারের অনুষ্ঠান এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ছাড়াও বিশে^র যে কোন প্রান্ত থেকে মোবাইল ফোন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত হতে পারছেন। জানাতে পারছেন তাদের মতামত ও সমস্যার কথা।
বর্তমান আঞ্চলিক পরিচালক নিতাই কুমার ভট্টাচার্য বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধুনিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখন অনুষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে, যা ফেসবুকের মাধ্যমে মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে লাখ লাখ শ্রোতার কাছে। নির্মাণ করা হচ্ছে ইউটিউবভিত্তিক কনটেন্ট। খুলনা বেতারে শ্রোতাদের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী অনুষ্ঠান নির্মাণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড নিয়ে অনুষ্ঠান ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান গানে গানে কিছুক্ষণ, প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কৃষি কার্যক্রম নিয়ে অনুষ্ঠান চাষাবাদ, স্বাস্থ্যবিচিত্রা, ভূমির কথাসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আধুনিকায়ন করেছি।
খুলনা বেতারের অনুষ্ঠান ফেইসবুকে লাইভ সম্প্রচারের ফলে শ্রোতাদের আগ্রহ কয়েকগুণ বেড়েছে। শ্রোতারাও এসব অনুষ্ঠানে সরাসরি সংযুক্ত হতে পারছেন বলে খুলনা বেতারের শ্রোতাসংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়ছে। এছাড়া খুলনার বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ এখন খুলনা বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করছেন এবং শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ এর উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অনুষ্ঠানের আধুনিকায়ন ও স্মার্ট সম্প্রচারের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সত্তরের দশকে খুলনা শহরের বুক চিরে সরু রাস্তার গন্তব্য ছিল নির্জন বিল এলাকা গল্লামারি। গল্লামারী ব্রীজ পার হয়ে কিছুটা দূরে বর্তমানের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনটিই ছিল খুলনা বেতারের প্রথম ভবন। আঞ্চলিক পরিচালক ইব্রাহিম আখন্দ’র নেতৃত্বে সহকারি পরিচালক আব্দুল মালেক, অনুষ্ঠান সংগঠক গোলাম কবির ও কাজী মাহমুদুর রহমান এবং অনুষ্ঠান প্রযোজক সামছুর আলী বিশ্বাস ও মুন্সি আহসান কবীর-শিল্পী সংগ্রহ থেকে শুরু করে অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় নতুন নতুন সৃষ্টির আনন্দে দিন-রাত এক করে ফেলতেন। অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে পরে এসে যোগ দিয়েছিলেন আব্দুস সাত্তার শেখ ও ওয়ালিউর রহমান।
সংবাদ অনুবাদক ও পাঠক আহমদ আলী খান, লিয়াকত আলী ও হুমায়ুন কবির বালু, সঙ্গীত প্রযোজক আব্দুল হালিম চৌধুরী, সৈয়দ নুরুল ইসলাম মুফতি ও আব্দুল মজিদ এবং নাট্য প্রযোজক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন নানা সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে অনুষ্ঠানের মান শ্রোতাপ্রিয় করতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকতেন।
প্রায় ৪০ জন সঙ্গীত শিল্পী আর ২০ জন নাট্যশিল্পী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্র। কথকও ছিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন। অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলেন রেহানা আখতার, সুরাইয়া বেগম ও জহির শমসেরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন আহসান আরা রুমী, জেবুন্নেসা বেগম, সেলিনা বিলকিস আনার, শেখ আব্দুস সালাম, শেখ বজলার রহমান, শাহ্ মোহাম্মদ ইয়াসীন, শাম্মী আখতার। যন্ত্র সঙ্গীতে ছিলেন শেখ আলী আহম্মেদ, দুলাল চন্দ্র শীল, ফজলে আকবর, মোঃ সাদ্তকী ও আব্দুল মজিদ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গল্লামারীর নির্জন বিল এলাকায় যে গণহত্যা সংগঠিত হয় খুলনা বেতার তার নীরব সাক্ষী। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ গল্ল¬ামারী বেতার ভবনের পুলিশ ব্যারাক পাকিস্তানি সৈন্যরা দখল করে নেয় এবং সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ন’মাস বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়ে বাংলাদেশে যে অসংখ্য বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিল খুলনার গল্লামারী তার অন্যতম। প্রতিদিন ট্রাক বোঝাই করে হাত-পা-চোখ বেঁধে অসংখ্য বন্দীকে আনা হতো গল্লামারীতে। খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হতো তাদের।
স্বাধীনতার পর চৌকস অফিসারসহ এক ঝাঁক গুণী মানুষ যোগ দেন খুলনা বেতারে। অনুষ্ঠানে আসে নতুনত্ব। সঙ্গীত, নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের অতুলনীয় নির্মাণ, স্বর্ণালী সে দিনগুলোতে খুলনা বেতারকে রাঙিয়ে তুললো ভিন্ন রঙে। অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে উঠলো খুলনা বেতারের অনুষ্ঠানমালা। সেসময় খুলনা বেতারের অনুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছেন সাধন সরকার, অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক, প্রণব ঘোষ, কবিয়াল বিজয় সরকার, রণজিৎ দেবনাথ, শামছুদ্দিন আহমেদ, মালেক চিশতি, কালিপদ দাস, বিনয় রায়, সাধন ঘোষ, ফরিদা পারভীন, আবু জাফর, শাম্মী আখতার, নাসির হায়দার, গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, আনোয়ারুল কাদির, খালিদ হাসান মিলু, আব্দুস সবুর খান চৌধুরী, লায়লা বিলকিস খান চৌধুরী, মোখলেসুর রহমান বাবলু, আনোয়ার কবির, নাসিরুজ্জামান, শাহ আলম বাদল, রেশমা চৌধুরী, হামিদুর রহমান, সাহিদা আক্তার পুতুল, অপূর্ব রায়, অশোক কুমার দে, গুরুপদ গুপ্ত, নাসির জবেদ, সাইদুর রহমান সাইদ, মাজেদ জাহাঙ্গীর, গাজী আব্দুল হাকিম, জাহাঙ্গীর আলম, মোঃ গোলাম মোস্তফা, দেলোয়ার হোসেন, শেখ আফজাল হোসেন, মোর্তজা আহমেদ বাবু, লুৎফুন নাহার লতা, বীণা মজুমদার, হাসান আলী, মোঃ আকরামুজ্জামান, সেগুফতা আহমেদ, সেলিনা আক্তার নার্গিস প্রমূখ।
১লা জুলাই ১৯৭৯। সর্বাধুনিক ব্রডকাস্টিং হাউজ হিসেবে খুলনার বয়রায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশ বেতার কর্তৃক নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ বেতার ভবন। স্টুডিও ৪টি। সেখানে সারাক্ষণ চলছে শব্দের ভাঁঁজে তথ্যের সন্ধি, স্বরের সঙ্গে সুরের কাব্যিক মাত্রা, মনের অচেনা গলিতে অযান্ত্রিক অনুভূতির উপস্থাপন। সেইসাথে উৎকীর্ণ শ্রোতার সমান্তরাল যাত্রা। খুলনা বেতার থেকে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যের প্রতিধ্বনি যেন পূর্ণতা পায় একেকটি দৃশ্যকল্পে। সেখানে চিত্রিত হয় নির্মোহ দৃষ্টির ইতিহাস। মাইক্রোফোনে প্রাণ পায় পরিবেশের বেপরোয়া আর্তনাদ, প্রকৃতির পূর্বাভাস। বন্দি হয় ধর্মের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মানবিক সমাজের সচকিত উচ্চারণ। শ্রুতিমধুর বাক্যগঠন চিনিয়ে দেয় বাণিজ্যের সওদাগর থেকে চিলেকোঠার সেপাই জীবন। উপলব্ধির বৈচিত্র্য পূর্ণতা পায় দৃষ্টিপাতে। রূপায়িত হয় স্বাস্থ্যের মানচিত্র। এসবই খুলনা বেতারের নিত্যদিনের পরিবেশনা।
আজকের শিশু-কিশোররাই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স¦প্নের সোনার বাংলাদেশ গড়বে। তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে গড়ে তুলতে খুলনা বেতার, বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে সেই কাজটিই করে যাচ্ছে সৃজনশীল পরিকল্পনায়।
লেখক : গীতিকার, নাট্যকার, অনুষ্ঠান নির্মাতা এবং ব্যুরো চীফ, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) খুলনা।
খুলনা গেজেট/কেডি