খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সেনাকুঞ্জে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া
  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা ৬ মামলা বাতিল করেছে হাইকোর্ট

ঐতিহাসিক বদর দিবস; ইসলামের ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রথম যুদ্ধ

শেখ দিদারুল আলম

পৃথিবীর ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলোর মধ্যে বদর ছিল অন্যতম। এটা ছিল আদর্শিক সংগ্রাম, হক বাতিলের লড়াই, ইসলামের প্রথম সিদ্ধান্তকর সামরিক অভিযান। আল্লাহর সাহায্যের অনুপম দৃষ্টান্ত। হিজরি ২য় বর্ষের রমজান মাসের ১৭ তারিখ এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটা ব্যাহত যুদ্ধ হলেও বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এর ফলে একটি সুমহান বিপ্লব সূচিত হয়। সৈন্য স্বল্পতা, অস্ত্রশস্ত্রের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও মহান আল্লাহর সাহায্যে এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। আর শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় কাফেররা।

‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন অথচ তোমরা ছিলে হীনবল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায়, তোমরা শোকরগুজার হবে। স্মরণ করো, যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে, ‘তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের রব তোমাদের তিন হাজার নাজিল করা ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবেন?’ হ্যাঁ, যদি তোমরা ধৈর্য ধরো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, আর তারা হঠাৎ তোমাদের মুখোমুখি এসে যায়, তবে তোমাদের রব পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন। আর আল্লাহ তোমাদের জন্য তা শুধু সুসংবাদস্বরূপ নির্ধারণ করেছেন এবং যাতে তোমাদের অন্তরসমূহ এর দ্বারা প্রশান্ত হয়। আর সাহায্য শুধু পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ ( সুরা আলে ইমরান ১২৩-১২৬)

দুটি ভিন্ন আদর্শের প্রেক্ষিতে বদর যুদ্ধ সংঘটিত। একটি ছিল তাওহীদ তথা একাত্ববাদী আদর্শ, অন্যটি ছিল লাত, মানাত, ওজ্জার আদর্শ। এদিকে কুরাইশ বাহিনীর সংখ্যা ছিল এক হাজারের অধিক, সঙ্গে ছিল সে যুগের উন্নত সব ধরনের অস্ত্র, সাতশ’ উট, একশ’ অশ্ব। কুরাইশদের নেতৃত্ব পর্যায়ের সবাই এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেনাপতি ছিল উতবা বিন রাবিয়া। মদ, নারী, যুদ্ধ সংগীতের মূর্ছনা সবকিছু নিয়ে এ বাহিনী যুদ্ধ উত্তেজনায় অস্থির ছিল। কুরাইশ বাহিনী যে স্থানে অবস্থান করেছিল সেটাও ছিল সুবিধাজনক। অন্যদিকে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ৩১৩ জন। যুদ্ধসম্ভার ও রসদপত্র ছিল অপ্রতুল, বাহন ছিল ৭০টি উট, ২টি অশ্ব, ৬টি লৌহবর্ম ও ৮টি তরবারি। অবস্থানের ক্ষেত্রে ছিল অসুবিধাজনক জায়গা।

বদর প্রান্তে যেখানে রাসুল (সা.) অবতরণ করেছিলেন মুশরিকরা সেখানকার পানি দখল করে নিয়েছিল এবং মুসলিম বাহিনী ও পানির মাঝে তারা প্রতিবন্ধক রূপে দাঁড়িয়েছিল। ওই সময় শয়তান মুমিনদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। সে বলে- তোমাদের মধ্যে স্বয়ং রাসুল (সা.) উপস্থিত, অথচ পানির ওপর দখল তো মুশরিকদের। আর তোমরা পানি থেকে এমনভাবে বঞ্চিত যে, নাপাক অবস্থায় সালাত আদায় করছো। তখন আল্লাহ রহমের বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। মুসলিম বাহিনী পানি পান করল এবং পবিত্রতা অর্জন করল। আল্লাহ মুমিনদের অন্তরকে পবিত্র করলেন এবং শয়তানের কুমন্ত্রণার সমুচিত জবাব দিলেন। ‘স্মরণ করো, যখন তিনি তোমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন তার পক্ষ থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর যাতে এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের পবিত্র করেন আর তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর করেন, তোমাদের অন্তরসমূহ দৃঢ় রাখেন এবং এর মাধ্যমে তোমাদের পা-সমূহ স্থির রাখেন।’ (সুরা আনফাল : ৮)

বৃষ্টিবর্ষণের ফলে মুসলিমদের দিকের বালু জমে শক্ত হয়ে গেল। ফলে সৈন্যবাহিনী ও পশুগুলোর চলাফিরার সুবিধা হলো। আল্লাহতায়ালা বদর প্রান্তে মুমিনদের স্বীয় নেয়ামত ও অনুগ্রহ করে তন্দ্রার মাধ্যমে ইহসান করেন। নিজেদের সংখ্যাস্বল্পতা এবং শত্রুদের সংখ্যাধিক্যের অনুভূতি তাদের অন্তরকে কিছুটা সন্ত্রস্ত করেছিল। এ সময় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করে আল্লাহ তাদের মনে প্রশান্তি আনয়ন করেন। আল্লাহর বাণী- ‘স্মরণ করো, যখন তিনি তোমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন’। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘যুদ্ধের দিন এই তন্দ্রা যেন আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালার পক্ষ থেকে এক প্রকার শান্তি ও নিরাপত্তা ছিল।’ (তাবারি)।

বদরযুদ্ধের দিন রাসুল (সা.) সাহাবিদের প্রতি লক্ষ্য করে দেখেন, তাদের সংখ্যা ছিল তিনশোর কিছু বেশি। এরপর মুশরিক বাহিনীর দিকে লক্ষ করে দেখেন, তাদের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। তখন রাসুল (সা.) চাদরমুড়ি দিয়ে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে থাকেন। ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণ করুন। হে আল্লাহ! আজ যদি ইসলামের এ দলটিকে আপনি ধ্বংস করেন তাহলে পৃথিবীতে আর কখনো আপনার ইবাদত করা হবে না।’

রাসুল (সা.) অব্যাহতভাবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়, আবু বকর (রা.) চাদরটি কাঁধে উঠিয়ে দেন এবং বলেন- ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে আবেদন করেছেন। অচিরেই তিনি তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। তখন আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন। ‘আর স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে ফরিয়াদ করছিলে, তখন তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদের পরপর আগমনকারী এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করছি। আর আল্লাহ তো তা করেছেন কেবল সুসংবাদস্বরূপ এবং যাতে এর দ্বারা তোমাদের অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয় এবং সাহায্য তো আল্লাহর পক্ষ থেকেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আনফাল ৯-১০)

আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস, মজবুত ইমান, শাহাদাতের তামান্না, আল্লাহর ওপর পূর্ণনির্ভরতা, নেতার আনুগত্য সব মিলিয়ে মুসলিম বাহিনী সেদিন খোদার প্রেমে উজ্জীবিত একটি বাহিনীতে রূপ নেয়।

বদর যুদ্ধকে আল্লাহতায়ালা ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা বাছাই করে নিয়েছেন। কারা তার সন্তুষ্টিতে ধন-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র, এমনকি জীবনের নাজরানা পেশ করতে প্রস্তুত। প্রকৃত মুমিনের স্বরূপ এমনটাই হওয়া উচিত। আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নে সোনালি সমাজ গড়তে অন্য কোনো মোহ বিন্দুমাত্র টলাতে পারে না।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!