ধানমন্ডি থানার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আমার পারফরম্যান্স দেখে ডিসি সাউথ জনাব আমিনুল ইসলাম এবং ডিসি ডিবি জনাব শফিউল্লাহ সাহেব ভীষণ খুশি ছিলেন। ডিবি অফিসের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব। তিনিও আমার পারফরম্যান্স সম্পর্কে জানতেন। জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেব একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আমার একজন ভাল অফিসার দরকার। তুমি রাজি থাকলে তোমাকে পোস্টিং করে আনবো’।
জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সম্পর্কে আমার অনেক কথা বলার আছে। তিনি আমার চাকরি জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। তাঁকে নিয়ে অন্য একটি পর্ব লেখার ইচ্ছে আছে।
যাহোক, আমাকে ডিবি অফিসে পোস্টিং করানোর বিষয়টি অতি দ্রুত জানাজানি হয়ে গেল। ধানমন্ডি থানার ওসি জনাব আব্দুল মতিন সাহেব বেঁকে বসলেন। তিনি সাথে সাথে বিষয়টি ডিসি সাউথ মহোদয়কে জানিয়ে আমাকে ধানমন্ডি থানায় রেখে দওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। ওদিকে ডিসি ডিবি মহোদয় নাছোড়বান্দা। ডিবি অফিসের পিআর সেকশনে তখন অফিসার সংকট চলছিল। অন্যদিকে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম মারাত্মক আকার ধারণ করছিল। সুতরাং পিআর অফিসে দক্ষ অফিসার প্রয়োজন ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পিআর অফিসে সাংবাদিকদের ভীড় জমতো। তাদের খুশি করা ও সংবাদ পরিবেশন করাই ছিল ডিবি পিআর অফিসের প্রধান কাজ।
একদিন ডিসি সাউথ মহোদয় হঠাৎ সরাসরি আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি চাও? ডিসি ডিবি সাহেব তোমাকে তাঁর কাছে নিতে চান, সেটা তুমি জানো’?
আমি বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলাম। আমি বললাম, জী স্যার। এসি পিআর সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন।
ডিসি সাউথ মহোদয় অত্যন্ত জেদি মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন, ‘যাও থানায় গিয়ে ঠিকমতো কাজ কর। আমি বিষয়টি দেখছি’।
ডিসি সাউথ অফিস ও ডিবি অফিস একই ভবনে থাকায় ডিবি পিআর অফিসে এসি জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবের সাথে দেখা হতেই তিনি বললেন, ‘তুমি কি জয়েন করতে এসেছো’?
আমি বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলাম। তিনি এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন যে, আমার পোস্টিং হয়ে গেছে।
তিনি আমাকে চা অফার করলেন। আমার ব্যাচমেট হান্নান ও মতিন তখন পিআর অফিসে ছিলেন। তারা দুজনেই সদ্য পদোন্নতি পেয়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মূলতঃ তাদের শুণ্য স্থানে আমাকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য এতো টানাটানি শুরু হয়েছিল।
ডিসি সাউথ এবং ডিসি ডিবি মহোদয়ের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের এক পর্যায়ে আমার পোস্টিং হলো ডিবি অফিসে। পরম শ্রদ্ধেয় এসি জনাব মোঃ খালেক উজ জামান সাহেবের সান্নিধ্যে এসে ডিবি পিআর সেকশনে কাজ শুরু করলাম। পাশাপাশি ক্রাইম সেকশনের কাজও করতে হতো। বিকাল চারটার পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মুলতঃ পিআর সেকশনের কাজ বেশি ছিল। সকালে শুধুমাত্র পেপার কাটিং করে ডিসি ডিবি ও মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করতে হতো। এরশাদ পতনের আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার কারণে নতুন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিনের প্রেস রিলিজ পৌঁছে দেওয়া শুরু হলো। এমনকি প্রতিদিনের প্রেস রিলিজ তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পলিটিক্যাল শাখার জয়েন্ট সেক্রেটারি জনাব আব্দুল হামিদ চৌধুরী মহোদয়ের কাছে হাজির করলে, তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবের অনুমোদন নিয়ে তারপর সাংবাদিকদের কাছে দেওয়ার নির্দেশ হলো। এই কঠিন কাজটি প্রতিদিন আমাকেই করতে হতো। সন্ধ্যার সময় জনাব আব্দুল হামিদ চৌধুরী সাহেব আমার কাছ থেকে দৈনন্দিন প্রেস রিলিজ নিয়ে দ্রুত পড়ার পর গাড়ি নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবের কাছে যেতেন। তাঁর অনুমোদিত অংশটুকু সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশন করা হতো। মাঝে মাঝে জনাব চৌধুরী সাহেব বলতেন, ‘আজকের প্রেস রিলিজ কে লিখেছে’?
আমি যখন বলতাম- আমি।
তখন তিনি ব্যস্ততার জন্য সেটা না পড়েই আমার উপর আস্থা রেখে কাগজ নিয়ে গাড়িতে উঠতেন।
১৯৯০ এর এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলো। ইতোমধ্যে আমি পিআর সম্পর্কে বেশ ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম। সমগ্র ডিএমপি এলাকার প্রতিটি ভালমন্দ ঘটনা প্রতিদিন থানা থেকে সংগ্রহপূর্বক প্রেস রিলিজ তৈরী করে সন্ধ্যায় সমস্ত খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পৌঁছে দেওয়া পিআর সেকশনের মূল দায়িত্ব ছিল। সুতরাং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানা লাগতো। সাংবাদিক সাহেবরা সঠিক তথ্য পেতে আমাদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখতেন। আমরাও তাদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করতাম। অনেক সময় কিছু কিছু তথ্য গোপন করলেও তাঁরা পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে আমাদের অনুরোধ রক্ষা করতেন।
১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করায় আমাদের অফিস শুরু হলো শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। সকল ডিসি মহোদয় প্রায় রাতদিন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে পুলিশ কমিশনার মহোদয় নিজে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান করতেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ওয়ারলেস অপারেটিং করতেন কয়েকজন দক্ষ কনস্টেবল। তাদের দক্ষ নির্দেশনা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এক পর্যায়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ডিসি সাউথ মহোদয় নিজেই কন্ট্রোল রুমে ওয়ারলেস অপারেটিং করতেন এবং নিজে দিকনির্দেশনা দিতেন।
একদিনের কথা আমার কানে আজও বাজে। মতিঝিল আল্লাওয়ালা ভবন এলকায় হরতাল ডিউটিরত একজন অফিসার ওয়ারলেসে বললেন, ‘স্যার আমরা মরে গেলাম। আমাদের বাঁচান। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা আমাদের আক্রমণ করেছে। আমরা এখন কি করবো’?
তখন ডিসি সাউথ মহোদয় কন্ট্রোল রুমের ওয়ারলেসে বাধ্য হয়েই বললেন, ‘তোমার কাছে রাইফেল দেওয়া হয়েছে কী জন্য? ওটা কি লাঠি! তারপর ওয়ারলেসে শুধু গুলির শব্দ ভেসে আসছিল’।
দিনরাত কাজ করতে গিয়ে একদিন হঠাৎ ডিসি সাউথ মহোদয় কন্ট্রোল রুমে অচেতন হয়ে গেলেন। এর আগে কয়েকদিন একটানা তিনি কন্ট্রোল রুমে থেকেছিলেন এবং সেখানেই সামান্য কিছু খেতেন। এই সংবাদ মহামান্য রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেবও জানতেন। তাই ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আগে ৪ ডিসেম্বর তিনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে সবার সাথে দেখা করতে এসে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আমিনুল কোথায়? এখন তাঁর শরীর কেমন’? চলবে…
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)
খুলনা গেজেট/ টি আই