স্বাধীনতার ৪৩ বছর আর ভাষা আন্দোলনের ৬২ বছর পর শেষ জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কোষে ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এম নূরুল ইসলাম দাদুভাই। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শেষ পর্যায়ে স্বপ্ন আর বাস্তব মেলাতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশের মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত না হবার আক্ষেপ নিয়েই চলে গেলেন এই নেতা। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পাননি বলে অভিযোগ ছিল তাঁর। ২০১৪ সালের ১৫ জুন এ প্রতিবেদকের সাথে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সমসাময়িক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মনোকষ্ট প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ‘এমন বাংলাদেশ তো চাইনি’ বলেছিলেন এই ভাষাসৈনিক।
২১ অক্টেবর, বুধবার সকাল ৮টার দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন এই সংগ্রামী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘খুলনা গেজেট’ পাঠকদের সামনে বর্ষীয়ান রাজনীতিক নূরুল ইসলাম দাদুভাইয়ের সেই কথাগুলো প্রকাশ করা হলো।
ভাষাসৈনিক এম নূরুল ইসলাম দাদু ভাই বলেছিলেন, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালীদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কার্জন হলে ঘোষণা করলেন Urdhu And Urdhu is the State Language of Pakistan. এটা বাংলা ভাষাভাষীরা সহজভাবে নেয়নি। শুরু হয় অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল-মিটিং, হরতাল শুরু হল। মূলত, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ওই বক্তব্য ঘি ঢেলে আন্দোলন আগুনের দাবানল বাঁধলো। কোনভাবেই আমরা কেউ মেনে নিতে পারছিলাম না উর্দুকে। ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণ থেকে যখন এটা গণহত্যায় রূপ নিচ্ছিল এবং অসংখ্য ছাত্রনেতা নিহত হল। তখন আমরা খুলনায় শহীদ আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে শেখ মঈনুদ্দিন আহমেদ, আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস, একেএম শামসুদ্দিন শুনু, সমীর আহমেদ, অধ্যক্ষ মাজেদা আলী, মালিক আতাহার উদ্দিন, মরহুম আব্দুল গফুর, গাজী শহিদুল্যাহ এবং জানা-অজানা অসংখ্য কর্মী প্রতিবাদের কণ্ঠে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ি। প্রতিদিন মিটিং-মিছিল অবিরাম গতিতে চলতে থাকলো। ভাষা আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে খান এ সবুরের নেতৃত্বে বিহারী গুন্ডাদের হামলায় আমাদের অনেকেই আহত হয়েছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশের হাতে গ্রেফতারবরণ করেছিলেন আমাদের অনেকেই।
২২ কি ২৩ ফেব্র“য়ারি ঢাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা একেএম নূরুল ইসলাম আসলেন খুলনার গান্দী পার্কে (বর্তমান শহীদ হাদিস পার্ক)। ওইদিন গান্দী পার্কে এক সমাবেশের মাধ্যমে বক্তারা ভাষা আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে উৎসাহিত করলেন। আমরা ক্রমাগত মিটিং-মিছিলের সাথে সাথে টিনের কৌটা কেটে ফান্ড সংগ্রহে তরুণ নেতাকর্মীরা কাজ করছিলাম। এসময়ের একদিন আবু মোহাম্মদ ফেরদৌসের নেতৃত্বে কিছু স্কুল ছাত্র মিলে একটা বিক্ষোভ মিছিল বের করি। সে মিছিল নিয়ে যখন পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে বর্তমান পাইওনিয়ার কলেজের পাশে যাচ্ছিলাম, তখন খান এ সবুরের লেলিয়ে দেয়া বাহিনী আমাদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। আমরা তাদের লাঠি-সোটা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রতিহত করলাম। বেদম পিটুনির মুখে তারা পরাস্ত হতে বাধ্য হল। তারা রাস্তায় লুটে পড়ল। কেউ কেউ পালিয়ে গেল। সেই আক্রমনে খান এ সবুরের বাহিনী পরাস্ত হল। পরে মিছিল নিয়ে সার্কিট হাউসের পাশ দিয়ে যখন খান এ সবুরের বাড়ীর সামনে দিয়ে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলাম, যখন পুলিশ আমাদের গতিরোধ করলো। আমরা সেদিনের মত মিছিল-মিটিং বন্ধ রাখলাম, তবে ক্ষ্যান্ত হল না আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম। সে আন্দোলন সারাদেশের ন্যায় খুলনাসহ পাশ্ববর্তী সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটসহ বিভিন্ন শহরতলীতে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, আমরা সে সময় বর্তমান শহীদ হাদিস পার্কে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পনের জন্য একটা শহীদ মিনার তৈরি করি। তখন কিন্তু আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা আরও বেশি হচ্ছিল। পুরো মাস জুড়েই মিছিল-মিটিং, সংঘর্ষ, আক্রমন-পাল্টা আক্রমন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এভাবে বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে আসীন করার এক মুহুর্ত পূর্ব পর্যন্ত আন্দোলন স্তব্ধ হয়নি। সমগ্র জাতি তখন ঐক্যবদ্ধ। মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ, গ্রেফতার, আক্রমন ও পাল্টা আক্রমনে গোটা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল। আমরা প্রতিদিন গান্দী পার্কে এসে একত্র হয়ে রেডিও শুনে এবং ইন্ডিয়ান পত্রিকা পড়ে খবর জানতাম। এসময় মাজেদা আলীর নেতৃত্বে আমরা মেয়েদের সংগঠিত করে মিছিল করিয়েছিলাম। আমরা কখনো গ্রেফতার এড়িয়ে চলতে খুলনা শহরেই আত্মগোপন করে থেকেছি। কিন্তু আমরা কখনো ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ফসলকে ব্যর্থ হতে দেইনি, দেবো না। ওই আমাদের সংকল্প। সে সময়ে আমাদের সাথে আরও অনেক নেতাকর্মী জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাদের সকলের নাম আমার স্মরণ না থাকলেও আমার অন্তর লেখনীতে তাদের নাম স্পষ্ট রয়েছে। ওই ভাষা আন্দোলনের বীরত্ব থেকে আমাদের স্বাধীকার আন্দোলন। মাওলানা ভাসানীর স্বাধীকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন।
ভাষা সৈনিক এম নুরুল ইসলাম আরও বলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বর্তমান বাংলাদেশ অবধি যত আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে বা হবে এর মূল সূতিকাগার হচ্ছে বয়ান্নের ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ বপন হয়েছিল। এটা ফলে-ফুলে প্রস্ফুটিত হয়ে বাংলাদেশের জন্ম। মায়ের ভাষা বাংলাকে মর্যাদার আসনে বসাতে আন্দোলন করেছি, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধা করেছি। একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝেছি, গোটা জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন কেউ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না? শেষ পর্যন্ত শত অত্যাচারের স্ট্রীম রোলার আমরা পায়ে মাড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধেও বিজয়ী হলাম। সেই ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো আমাদের মুক্তির যুদ্ধ শেষ হয়নি। বাংলা ভাষা এখন আমাদের কাজকর্ম ও ব্যবহারে অবহেলিত। আবার স্বাধীনতার স্বাদও পাচ্ছে না জাতি। তাই যতদিন প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল জাতি না পাবে ততোদিন চলবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, এই হোক বাংলাদেশীদের শপথ। আমি একদিন থাকবো না, তবে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের লড়াই যেন স্তব্ধ না হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে।
বর্ষিয়ান রাজনৈতিক দাদু ভাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছি। শুধু স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চেয়েছি। আজও পায়নি। আমার জীবদ্দশায় মনে হয় তা আর হবে না। স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও একটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ হলো না। আজ সরকার বিরোধী দল-মতের মানুষেরা কথা বললেই হামলা-মামলা দিতে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এর মানেই স্বাধীনতা? আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, গুম-গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও বাকশালী শাসনের প্রতিবাদ করলেই হয়ে যাই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি? এর জন্যই কি যুদ্ধ করেছিলাম? কোন গোষ্ঠির চেষ্টায় আজকের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সকল সম্প্রদায়ের মিলিত শক্তি সমন্বয়ে আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়েও স্বাধীনতা পরবর্তী ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল-মতের বৈষম্য যে কতটা যন্ত্রনাদায়ক তা এখন বুঝতে পারছি! সত্যি ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা আজও পূরণ হয়নি।”
তিনি বলেন, “আয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করেছি, ৬৮, ৬৯ এর ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, কারাবরণ করেছি। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যূত্থানে খুলনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলাম, কারাবরণও করতে হয়েছিল। সকল যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলাম। কিন্তু আজ আমার বাংলাদেশে কি হচ্ছে। এমন বাংলাদেশ তো চাইনি। প্রত্যেকটি মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়নি।” অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে দু‘চোখের গড়িয়ে পড়া অশ্র“ মুছলেন ভাষা সৈনিক এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই। কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন তিনি। পরে বললেন, “নতুন প্রজন্মের উচিত ঐতিহ্যের ইতিহাস জেনে-বুঝে তাদের দায়িত্ব পালন করা। আগামী প্রজন্ম যদি সম্মিলিতভাবে আবার একটা বিপ্লব করে দেশকে সত্যিকার অর্থে মুক্তির স্বাদ এনে দেয়; তবে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সফল হবে। শান্তি পাবেন বীর শহীদরা।”
খুলনা গেজেট/এআইএন