খুলনা, বাংলাদেশ | ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলায় ৩ পুলিশ বরখাস্ত, গ্রেপ্তার ৭
  ভারতীয় সব বাংলা চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ চেয়ে করা রিটের শুনানি বুধবার
ওপার বাংলার চিঠি

‘এগিয়ে বাংলা’ অবনমনের পথে

মজিবুর রহমান

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা ও সমাজ সংস্কারক মহামতি গোপালকৃষ্ণ গোখলে (১৮৬৬-১৯১৫) বলেছিলেন, বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত ভাবে আগামীকাল। অখণ্ড ভারতে অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা এবং সমাজ সংস্কারের ধারাবাহিকতা দেখে অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়েই একজন মারাঠি ভদ্রলোক এই অতি উচ্চ প্রশংসামূলক উক্তিটি করেছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে। ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাও ভাগ হয়েছে।স্বভাবতই পুরনো পর্যবেক্ষণের প্রাসঙ্গিকতাও কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তবুও স্বাধীন ভারত আর তার অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে আমরা এতদিন ওই পর্যবেক্ষণকে অনেকটাই ইতিবাচকভাবে প্রযোজ্য হতে দেখেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘এগিয়ে বাংলা’ অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে। ইদানিং এই রাজ্যে ইতরামি, অসভ্যতা ও অসৌজন্যের ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই চলেছে। নির্লজ্জতা এবং বেহায়াপনায় বাংলা বহুদূর এগিয়ে গেছে। গত এক দশকে সে শুধু তার কলঙ্ক বৃদ্ধি করে চলেছে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

পশ্চিমবঙ্গ এক সময় ‘ভদ্রলোকের রাজনীতি’র জন্য বিখ্যাত ছিল। বিধানচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত সেই ধারাটি মোটের ওপর অনেকটাই অমলিন থেকেছে। নীতি-আদর্শ নিয়ে রাজনৈতিক তরজা হয়েছে। কর্মসূচি নিয়ে কথা হয়েছে।সরকার কিংবা দলের শীর্ষ পদাধিকারীরা একটা ন্যূনতম মান বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন? রাজনীতির রাশটা দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যাচ্ছে। শিক্ষিত সজ্জনরা যথাসম্ভব রাজনীতি এড়িয়ে চলছেন। অশিক্ষিত লুম্পেনরা রাজ করছে। যে যত বড় বাহুবলী সে তত বড় নেতা।রাজ্যের বর্তমান শাসকদল এতটাই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক যে তাকে রাজনৈতিক দলের বদলে প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। দল ও সরকারে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্প পোস্ট। সেই সুপ্রিমো অশুদ্ধ ভাষায় আর অশোভন ভঙ্গিতে অবিরাম অসংযত, অসংলগ্ন এবং অবান্তর উক্তি করেন। তিনি সবজান্তা! এটাই বাংলার অগ্ৰগতির নিদর্শন!

আদর্শগত কারণে দলের মধ্যে বিভাজন অথবা নেতৃবৃন্দের দলত্যাগ রাজনীতিতে একটি স্বাভাবিক ঘটনা।ডান-বাম সব দলেই এরূপ ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তবে আয়ারাম-গয়ারামের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের পরম্পরা নয়। কিন্তু রাজ্যে তৃণমূল সরকার গঠনের পর থেকে নেতানেত্রীদের দলবদলের বহর দেখে বলতে বাধা নেই যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ছোটলোকি কারবারে পরিণত হয়েছে। তাই ‘মুকুল’দের বাগান বারবার বদলে যায়। ‘লটেক-মালা’রা গলা চেঞ্জ করে। ‘শোভন-বৈশাখী’দের সঙ্গী পাল্টায়। নেতানেত্রীরা কে কখন কোন দলে থাকে, হিসেব রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ে। এই রাজনৈতিক বেশ্যাগিরি নিশ্চিতভাবেই নতুন আমদানি। এটাও বাংলার অগ্ৰগতির নমুনা!

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে যোগদান করার অনেক দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। মেধাবীদের একাংশ ক্যারিয়ার গঠনের কথা না ভেবে কোনো মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ডান-বাম সব দলের নেতৃবৃন্দের ক্ষেত্রেই এটা ঘটেছে।কিন্তু অতি সম্প্রতি এ রাজ্যে রাজনীতি শিক্ষকতা, ডাক্তারি, ওকালতির মতোই অর্থের বিনিময়ে দায়িত্ব পালনের পেশাতে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য পেশাতে একটা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপার থাকলেও ব্যবসার মতো রাজনীতিতে তার দরকার হয় না। সেই হিসেবে এখন কম পুঁজির সেরা ব্যবসা রাজনীতি। নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই, মুনাফা-উপার্জনই লক্ষ্য। তাই বিজেপির বিরোধী দলনেতা তাঁর পুরনো দল তৃণমূলকে রাতদিন তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেন কিন্তু তাঁর বাবা এবং ভাই মোটা অংকের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য তৃণমূলেরই সাংসদ পদে বহাল থাকেন। দলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন না।এই সুবিধাবাদী রাজনীতির ব্যবসায় পার্টির পদও বিক্রি হয়।বাংলা এগিয়েছে বলেই এসব ঘটছে!

দুর্নীতির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ অন্য কোনো রাজ্যের পেছনে না থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে! সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এখনকার শাসকদলের সংস্কৃতিতে সততার কোনো স্থান নেই।রাজ্যের মুখ্য মানুষটির অনুপ্রেরণায় যার যত বড় পদ সে তত বড় দুর্নীতিবাজ। প্রাইমারি এবং সেকেণ্ডারি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির যেটুকু পর্দা ফাঁস হয়েছে তাতে সবার চক্ষু চড়কগাছ। শিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী, আমলা এবং আধিকারিক সবাই জেলে। আর কোথায় এমন ঘটনা ঘটেছে? নিয়ম-নীতি মেনে কোনও কাজ সম্পন্ন হওয়াই এখন অস্বাভাবিক ব্যাপার। অনিয়ম আর দুর্নীতির পথ ধরেই দিদির ভাইয়েরা সব কোটিপতি হয়ে যায়। পিসির ভাইপো অট্টালিকা বানায় আর যখন তখন আমেরিকা, দুবাই যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলের তল্লাশিতে শাসকদলের নেতামন্ত্রীদের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়। লুটেপুটে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় তথা দুর্নীতির টাকার বখরা নিয়ে শাসকদলের অন্দরেই গ্ৰামে-গঞ্জে, পঞ্চায়েত-পৌরসভায় খুনোখুনি চলে। বীরভূমে বগটুই ঘটে। বাংলার ‘উন্নয়ন’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে!

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। এই রাজ্যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটা আলাদা কদর রয়েছে। তাঁরা সমাজের বিবেক হিসেবে কাজ করেন। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যের সমর্থনে সোচ্চার হতে পারেন। শিরদাঁড়া সোজা রেখে কথা বলতে পারেন।বিগত কয়েক বছরে পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই বদলে গেছে। সুশীল সমাজ তার দায়িত্ব পালনে নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীরা এখন অনেকটাই সিলেকটিভ হয়ে গিয়েছেন। তাই সমজাতীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা কখনও খুব সরব, কখনও একেবারে নীরব।ব্যক্তিগত স্বার্থে তাঁরা কার্যত ধান্দাজীবী হয়ে উঠেছেন। শাসকদল আর সরকারের অনুগ্ৰহ লাভ করাই তাঁদের লক্ষ্য। অর্থহীন অকার্যকর সরকারি কমিটির সদস্য হয়ে বেতন-ভাতা কিংবা সরকারি স্বীকৃতি-সম্মাননা পাওয়ার জন্য তাঁরা তাঁদের বিবেক বন্ধক রাখছেন।বুদ্ধিজীবী কথাটা ক্রমশ নিন্দাবাচক শব্দে পরিণত হচ্ছে। এভাবেই বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে এগিয়ে দিচ্ছেন!

বিচারব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গত দেড়-দুই বছরে পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটে চলেছে তা নজিরবিহীন। এতদিন বিচারব্যবস্থার ওপর অগাধ আস্থা আর বিচারপতির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে কোনো বিশেষ রায় নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার রীতি ছিল।আজ সেই আদালত চত্বরে পাড়ার ক্লাবের সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে। এজলাসের মধ্যে ‘ছাতুবাবুর হাট’ বসছে।আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতি হচ্ছে। বিচারপতির সঙ্গে কৌঁসুলিদের বাগবিতণ্ডা বেধে যাচ্ছে। বিচারপতির আইনি জ্ঞান এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কোনও নির্দিষ্ট মামলা থেকে কোনও নির্দিষ্ট বিচারপতিকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠছে।শাসকদল বা সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের অপছন্দের বিচারপতির এজলাস বয়কট করছেন। এজলাসের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হচ্ছে। এজলাস অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। বিচারপতির বিরুদ্ধে দেওয়ালে পোস্টার সাঁটানো হচ্ছে এবং জনসভায় অথবা সাংবাদিক বৈঠকে শাসকদলের নেতারা বিষোদগার করছেন। আবার আইনজীবীর বাড়িতে বিক্ষোভ মিছিল পৌঁছে যাচ্ছে।গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভকে সন্ত্রস্ত করার এমন ঔদ্ধত্য ও অসভ্যতা দেশের আর কোথাও হয়? সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় শুনানির সময় সরকারি আইনজীবী ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিত থাকছেন। সরকারের এই নিম্নমানের কৌশল মামলাকারী সাধারণ মানুষ বা সংস্থার স্বার্থের পরিপন্থী। মামলা লড়ার জন্য দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খরচ সর্বাধিক। আবার আদালতের রায় সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারি অনীহাও অপরিসীম। এটা আসলে আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর শামিল। আইন-আদালতকে অগ্ৰাহ্য করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পথে বাংলা সত্যিই এগিয়ে চলেছে!

এতদিন আদালতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রায় সংবাদ মাধ্যম অথবা সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতো। কিন্তু বিচারপতিরা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাঁদের খুব একটা দেখা যেত না।আবাস থেকে আদালত আর আদালত থেকে আবাস করেই তাঁদের কর্মজীবন কেটে যেত। জীবন যাপনে যাতে কোনো প্রকার বিতর্ক সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে তাঁরা সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকতেন।পত্রপত্রিকায় তাঁদের ছবি ছাপতো না।মানুষ তাঁদের চেহারাটাই দেখতে পেত না।তাঁরা কখনও মানুষের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আসতেন না। কলকাতা উচ্চ আদালতের দু’একজন বিচারপতি সম্পর্কে এখন আর একথা বলা যাবে না। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে বিচারপতি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বেসরকারি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলছেন। এজলাসের মধ্যে এমন মন্তব্য করছেন যা মূল মামলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। বাক সংযমের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।কখনও কখনও বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিচারপতি বলছেন, তিনি ভগবান থেকে শয়তান হয়ে গেছেন। ভগবান থেকে শয়তান হওয়া নিশ্চিতভাবেই চরম অবনমন। বিচারপতির কথাটা সার্বিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে প্রতীকী বলে মনে হয়।

লেখক : প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল, পশ্চিমবঙ্গ।

খুলনা গেজেট/কেডি




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!