দেশে ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। লাগামহীনভাবে বাড়ছে দাম। বিপরীতে কমছে টাকার মান। নানা পদক্ষেপ নিয়েও দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে খোলা বাজারে খুচরা ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ১২৬ থেকে ১২৭ টাকায়।
চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের নগদ প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১২৭ টাকা পর্যন্ত। এক সপ্তাহ আগেও খোলা বাজারে ডলারের দাম ছিল ১২০ টাকা। আর বছরের শুরুতে দাম ছিল ১১০ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি ডলারের বিপরীতে সপ্তাহে টাকার মান কমেছে ৭ টাকা, আর চলতি বছরে কমেছে ১৭ টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে আমদানির দেনা শোধ করতে পারছে না। তাই সংকট মোকাবিলায় অনেক ব্যাংক বাড়তি দামে প্রবাসী আয় কিনছে। এ সুযোগে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো হঠাৎ করে ১২ থেকে ১৪ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম। ফলে অনেক ব্যাংক বাধ্য হয়ে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকায় প্রবাসী আয় কিনেছে। এর প্রভাবে খোলা বাজারে ডলারের দামও হু হু করে বেড়েছে।
মতিঝিল দিলকুশার এলাকায় খুচরা ডলার কেনা-বেচা করেন আব্দুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকেও বাজার খুব চড়া। কেউ ডলার বিক্রি করতে আসলে ১২৫ থেকে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছি। আর কেউ কিনতে আসলে ১২৬ টাকা থেকে ১২৭ টাকায় বিক্রি করছি। বৃহস্পতিবারও ১২৬ টাকা ছিল।
কেন হঠাৎ দাম বাড়ল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে। এখন ব্যাংক ডলার কিনছে ১২৪ থেকে ১২৫ টাকা তাহলে খোলা বাজারে তো ১২৬-১২৭ টাকা হবেই।
অফিসের কাজে দুবাই যাবেন আরমান আরিফ। নগদ ডলার কেনার জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আজকে ডলার কেনার জন্য কয়েকটি ব্যাংকে খোঁজ নিলাম। কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে চায়নি। পরে কয়েকটি মানি চেঞ্জারে ফোন দিলাম আন-অফিসিয়ালি রেট ১২৬ টাকা ৫০ পয়সা চেয়েছে। এখনও ডলার কিনতে পারিনি। দেখি দাম কমে কি না। সামনের সপ্তাহে ফ্লাইট, এর মধ্যে দাম না কমলেও কিনতে হবে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ডলারের বাজার খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্থিতিশীল করার জন্য আমরা সব স্টেকহোল্ডার একসঙ্গে কাজ করছি। কিছু ব্যাংক বেশি সমস্যায় আছে, তাদের এ রেট মানতে সমস্যা হচ্ছে। এজন্য সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যেন বাজার অস্থিতিশীল না হয়।
তিনি বলেন, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণে রেমিট্যান্সের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনাসহ ডলারের দর কোনোভাবেই ১১৬ টাকার বেশি দর দেওয়া যাবে না। তবে আমদানিকারকদের কাছে ব্যাংকগুলোকে ১১১ টাকায় বিক্রি করতে হবে; এর বেশি নেওয়া যাবে না। কেউ যদি এটা অমান্য করে তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
ডলারের বাজার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, গত ৬ মাস এমন সমস্যা ছিল না; ডলারের দাম ১২৪ টাকা কখনো হয়নি। বাড়তি প্রণোদনা উন্মুক্ত করায় ডলারের বাজারে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এখন বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তারা (এবিবি ও বাফেদা) একটা রেট নির্ধারণ করেছে। তাদের নির্ধারিত রেট বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য চেয়েছেন। ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এ সূচকটি ধারাবাহিকতা কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন গ্রস রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর শর্ত অনুযায়ী বিপিএম-৬ ম্যাথোডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫.৭২ বিলিয়ন ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, গ্রস রিজার্ভ ২০ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হল বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।
খুলনা গেজেট/ এএজে