বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালনের সময় নানা ঘটনায় বারবার আলোচনায় এসেছিলেন সম্প্রতি নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়া পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।
১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া মি. আহমেদকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’, যার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিলো প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে তখনকার আইজিপি মি. আহমেদ বলেছিলেন, “স্বাধীনতা, সংবিধান, রাষ্ট্র ও জাতির জনক – নোবডি ক্যান টাচ দেম!”
বিরোধী দলগুলো প্রায়শই অভিযোগ করে যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ বাহিনীকে সরকারি দলের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তা ছাড়াও গত এক দশকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সময় ‘বিরোধী দল দমনে’ নানা পদক্ষেপ নিয়েও বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি।
সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে বিষয়টির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক।
যদিও গতমাসে একটি পত্রিকায় তার দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন তদন্ত বা সরকারি কোন অনুসন্ধানের কথা শোনা যায়নি।
ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার আবেদনে মি. আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ ও অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত আদালত বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের যে সব সম্পদ জব্দ বা ফ্রিজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে আছে ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, তিনটি শেয়ার ব্যবসার বিও অ্যাকাউন্ট, প্রায় ৬২১ বিঘা জমি, উনিশটি কোম্পানির শেয়ার এবং ত্রিশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও মি. আহমেদের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক জানান যে তারা এখনই এসব বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন।
তবে গত মাসেই এক ভিডিও বার্তায় বেনজীর আহমেদ দাবি করেছিলেন যে তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ মিথ্যা। অবসরের পরে তাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের চেষ্টা ‘হতাশাজনক ও দুঃখজনক’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
নিষেধাজ্ঞায় পড়া আইজিপি
পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ।
যদিও তিনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ মত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সম্পৃক্ততা’র জন্য।
কিন্তু আইজিপি থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেশে বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে। যদিও তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন কর্মকর্তা এবং র্যাবের ওপর ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেনজীর আহমেদ।
এরপর ওই বছরের পনেরই এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন।
“ক্ষমতাকে ব্যবহার ও প্রদর্শন করে একটা ভয়ের জায়গা তৈরি করেছিলেন তিনি। এটা করেছিলেন তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে। এখন যেসব অভিযোগ উঠছে এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে আগেও প্রকাশ হয়েছিল, কিন্তু সরকার তখন কান দেয়নি”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন।
শাপলা চত্বরের বিক্ষোভ দমন
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের যে অবরোধ কর্মসূচি ছিলো সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ বা ডিএমপির কমিশনার ছিলেন মি. আহমেদ।
হেফাজতে ইসলামীর বিশাল সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে তখন আলোচনায় এসেছিলেন বেনজীর আহমেদ।
তখন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে হেফাজতে ইসলাম সমাবেশের অনুমতি চাইলে ডিএমপি তাদের বিকেল পাঁচটার মধ্যে সভা শেষ করার শর্তে অনুমতি দিয়েছিল শাপলা চত্বর ব্যবহারের।
তবে এক পর্যায়ে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতা ঘোষণা দেন যে তাদের দাবি (তখন তারা ১৩ দফা দাবি দিয়েছিল সরকারের কাছে) না মানা পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করবেন।
এমন প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদিন মধ্যরাতেই সেখানে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ বাহিনী।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার হিসাবে সেই অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার ওপর।
হেফাজতে ইসলামীর সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দেবার কয়েকদিন পরে তৎকালীন ঢাকার পুলিশ কমিশনার হিসেব বেনজীর আহমেদ একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।
সেখানে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের সরিয়ে দিতে ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’ নামে অভিযান চালানো হয়।
এ অভিযানে ঢাকা মহানগর পুলিশ, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সম্মিলিতভাবে অংশ নেয়।
সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ দাবি করেছিলেন, এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল, কোনো রকম প্রাণহানি ছাড়া হেফজাতকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া।
“এ অভিযানে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গ্রেনেড, স্মোক গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কোনো প্রাণহানি হয় না। সারা দুনিয়ায় পুলিশ এসব ব্যবহার করে,” বলেন বেনজীর আহমেদ।
খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
সেই সময় বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিরোধে শক্ত ভূমিকা নিয়েছিল পুলিশ। সহিংসতায় অনেকে মারাও গিয়েছিলেন।
তখন বিরোধী কর্মীদের লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি করার অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। যদিও সরকার বা পুলিশ বিরোধী দল দমনের সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিল।
২০১৩ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনের সড়ক বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ।
তখন সেখানে আড়াআড়ি করে রাখা হয়েছিলো বালুর ট্রাক, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
বিএনপি নেতারা এ ঘটনার জন্য তখনকার ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
পরের বছর ৫ই জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়ে সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। সেবারও বালুর ট্রাক এনে খালেদা জিয়ার অফিসের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
এছাড়া মি. আহমেদ ডিএমপি কমিশনার, র্যাব মহাপরিচালক ও আইজিপি থাকার সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বেশি কঠোরতার শিকার হয়েছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই।
বিতর্কিত মন্তব্য
বেনজীর আহমেদ র্যাব-এর মহাপরিচালক থাকার সময় বহু বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তিনি কখনোই বিচার ‘বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ টার্মটিকে গ্রহণ করতেন না।
২০১৮ সালে ১৮ই মার্চ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ একটি ভুল শব্দ।
ডিএমপি কমিশনার, র্যাব মহাপরিচালক এবং পুলিশ প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকার সময় বেনজীর আহমেদ এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন যেগুলো পুলিশ ও র্যাবকে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে সহায্য করেছে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
র্যাব-এর মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকার ২০১৫ সালের ২৬ শে জানুয়ারি তিনি বলেছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি সস্তা প্রচারণা। একটি বিশেষ মহল এই প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত। তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা চেয়ে চেয়ে দেখবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কি অস্ত্র দেওয়া হয়েছে হাডুডু খেলার জন্য?’
পুলিশ প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকার সময় ২০২১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধ হলে কি আমাদের লোকজন বন্দুক ফেলে পালিয়ে চলে আসবে?
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। আমার মতে দেশের ইতিহাসে তিনিই মোস্ট ভিজিবল আইজিপি। তার মতো আর কোনও আইজিপিকে আমি এমন চলাফেরা করতে বা ভাষণ দিতে দেখিনি। তিনি যে পাওয়ারফুল সেটা বোঝাতে তিনি সবই করেছেন”, বলছিলেন মি. হোসেন।
বোট ক্লাব বিতর্ক
বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে ঢাকার বোট ক্লাবে অপ্রীতিকর ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রকাশ হয় যে ওই ক্লাবের সভাপতি তখনকার আইজিপি বেনজীর আহমেদ নিজেই।
২০২১ সালের জুনে ওই ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে এবং ওই ক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি পরবর্তীতে আটক হন। তারও পরে জেলে যেতে হয় ওই চিত্রনায়িকাকেও।
কিন্তু ঢাকার আশুলিয়ায় বোট ক্লাবের ছবি ও এর সভাপতি হিসেবে মি. আহমেদের নাম আসার পর তা ঝড় তোলে সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে।
এমনকি বিপুল অর্থ দিয়ে কীভাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই ধরনের ক্লাবের সদস্য হতে পারেন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে জাতীয় সংসদেও।
বিশেষ করে একটি বাণিজ্যিক ক্লাবের সভাপতি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আইজিপি থাকতে পারেন কি না, সে প্রশ্নও উঠেছিল তখন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন মি. আহমেদ তার পেশাগত কর্মকাণ্ডে যেমন বিতর্কিত হয়েছেন, তেমনি তার বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ উঠলেও তিনি রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম