শেখ কামরুজ্জামান টুকু। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে প্রিয় নাম। তাকে নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের অহংকার। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গর্বের অধিনায়ক। আজও মুক্তিযোদ্ধাদের সুখে দুখে জড়িয়ে আছেন।
বাগেরহাট জেলা সদরের সুনগগর গ্রামের সন্তান। জন্মেছেন ১৯৪৩ সালে (বাংলা ১৩৫০ সালের ১৪ মাঘ)। মরহুম এসএম বদিউজ্জামান তার পিতা আর মরহুমা রউফুন্নেছো তার মা। ১৯৬২ সালে লোহাগড়ার লক্ষীখোলা হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৪ সালে বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৬ সালে আযমখান কর্মাস কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬২ সালে পূর্ব পকিস্তান ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনীতিতে হাতে খড়ি। ১৯৬৪ সালে খুলনা শহর ছাত্রলীগের আহবায়ক ও ১৯৬৬ সালে কেন্দ্রীয় সহ- সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানে সক্রিয় আংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ বার কারাবরণ করেছেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আওয়ামী লীগের সভাপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। ১৯৭০ সালে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন (ড: শেখ গাউস মিয়া রচিত আলোকিত মানুষের সন্ধানে বৃহত্তর খুলনা জেলা)। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দায়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর তার পরামর্শে খুলনা শহরের বিভিন্নস্থানে ছাত্র ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জিলা স্কুল প্রঙ্গনে এ স্কুলের ক্যাডেটদের ডামি রাইফেল নিয়ে জয়বাংলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে তার নেতৃত্বে খুলনা শহরে কয়েকটি বন্দুকের দোকান লুট হয়। এখানে ছেটখাট অস্ত্র ভান্ডার গড়ে ওঠে।
২৫ মার্চ খুলনা শহরের পরিস্থিতি জানতে রাতে জিপে সতীর্থদের নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় টহল দেয়। খালিশপুর ফায়ার বিগ্রেডের কাছে পৌছালে তিনি জানতে পারেন পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালাচ্ছে। তারপর থেকে তিনি যুদ্ধের জন্য বিভিন্নস্থানে যুবকদের প্রস্তুতি নিতে বলেন। ২৭ মার্চ খুলনা আলিয়া মাদ্রাসার বিপরীতে কবির মঞ্জিলে বসে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাকে চেয়ারম্যান করে বিপ্লবী পরিষদের কমিটি গঠন করা হয় (বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য স, ম বাবর আলী, এ্যডঃ রচিত স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান)। ২৭ মার্চ রাতে তার নেতৃত্বে যুব সমাজ খুলনা সার্কিট হাউজস্থ সেনা সদর দপ্তর ও ইউডিএফ ক্লাবের (আজকের অফিসার্স ক্লাব) পাকিস্তানী সেনা ছাউনীতে আক্রমণ করে। ৪০ মিনিটকাল উভয়পক্ষের গুলি বিনিময় হয়। খুলনায় পাক বাহিনীর ওপর এই প্রথম গেরিলা আক্রমণ। যুব সমাজ সেদিন পিছু হেটে যায়। পরবর্তীতে ২৮ মার্চ পূর্ব রূপসার জাহানারা মঞ্জিলে তার নেতৃত্বে ক্যাম্প স্থাপন হয়। এটাই খুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প।
বরিশাল থেকে মেজর এমএ জলিল (পরবর্তীতে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার) বাগেরহাটে এসে খুলনা গল্লামারীস্থ রেডিও সেন্টার দখল করার পরামর্শ দেন। যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়। চিতলমারী থানার আড়ুয়াবর্ণি গ্রামের সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত সুবেদার শেখ জয়নুল আবেদীন রেডিও সেন্টার দখলের যুদ্ধে অধিনায়ক মনোনীত হন। ৪ এপ্রিল রূপসা নদী পার হয়ে প্রায় আড়াইশ’জন মুক্তিযুদ্ধা গল্লামারী অভিমুখী রওনা হন। যুদ্ধের সমন্বয় সাধন করেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ও বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামরুজ্জামান টুকু। যুদ্ধের অধিনায়ক জয়নুল আবেদীন হাবিবুর রহমান ও মোসলেম শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান।
তিনি বাগেরহাট থেকে কলকাতায় চলে যান। সেখানে পৌনে দু’মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাকে বৃহত্তর খুলনা জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৩ আগস্ট তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ১৯ জনের একটি দল দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। প্রথম পর্যায়ে ক্যাম্প স্থাপন হয় তালা থানার মাগুরায় এবং বেতডাঙ্গায়। পরে মুজিব বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয় পাইকগাছা থানার পাতড়াবুনিয়া গ্রামের রায় সাহেবের বাড়িতে। পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরা মহাকুমায় কালীগঞ্জ, শ্যামনগর, দেবহাটা, তালা, খুলনার পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও বাগেরহাট মহাকুমার রামপাল এবং শরণখোলায় মোট ৮০ টি ক্যাম্প স্থাপন হয়। অক্টোবর মাসের পাইকগাছা হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। তিনি ছিলেন এ যুদ্ধের অধিনায়ক। তার নির্দেশে ২৮ নভেম্বর বটিয়াঘাটা থানার বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প দখল করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাইকগাছার দেলুটি থেকে রওনা হয়। এ যুদ্ধের অধিনায়ক ছিলেন বটিয়াঘাটার বিনয় সরকার। ২৯ নভেম্বর বারোআড়িয়া শত্রুমুক্ত হয়। এখানে জোতিষ ও আজিজ নামে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে হারাতে হয়। ৩ ডিসেম্বর পাইকগাছার কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প দখল করার জন্য রাড়ুলিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প দখল যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সকল শক্তি নিয়োগ করে। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৫৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করে। জনতা তাদেরকে গণ আদালতে বিচার করার দাবি তোলে। এ আদালতের প্রধান কামরুজ্জামান টুকু তাদের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। এদের মধ্যে চারজন পালিয়ে যায়।
খুলনার বিভিন্ন থানা এলাকায় তখন স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। গল্লামরীস্থ রেডিও সেন্টারে সেনা ছাউনী দখল করার জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন শেষ দিকের ৯ নং সেক্টর কমান্ডর মেজর জয়নাল আবেদীন খানের নেতৃত্বে ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধার প্রথম অভিযান চালায়। প্রথমদফার অভিযান ব্যর্থ হলে মুক্তিযোদ্ধারা জলমা চক্রাখালী হাইস্কুলে ফিরে আসে। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকের নয় নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জয়নাল আবেদীন খান, লে: গাজী রহমতউল্লাহ দাদু বীর প্রতীক ও বৃহত্তর খুলনা মুজিব বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ ১৪-১৬ ডিসেম্বর গল্লামারীস্থ রেডিও সেন্টার দখলের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
১৭ ডিসেম্বর খুলনা শত্রুমুক্ত হয়। শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মুজিব বাহিনী সদস্যদের কমার্স কলেজ, নিউজপ্রিন্ট মিলসহ কয়েকটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে নিয়োজিত করা হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে খুলনা জেলা মুজিব বাহিনীর সদস্যরা তার নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র আত্মসমর্পন করেন।
খুলনা গেজেট/এএ