খুলনা, বাংলাদেশ | ২৮ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১৩ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  বিসর্জনে আজ শেষ হচ্ছে দুর্গোৎসব

‘একদিন আয় না করলে সংসার চলে না, তবুও বাঁচার তাগিদে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করি’

তরিকুল ইসলাম

“একদিন আয় না করলে সংসার চলে না, তবুও বাঁচার তাগিদে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে হয়। সব ভেসে গেছে, জিনিসের দাম বেড়েছে। সংসার চালানো নিয়ে চিন্তিত।” আপসোসের সাথে এমনটি জানালেন স্বেচ্ছাসেবায় রিং বাঁধ নির্মাণ করতে আসা এক উপকূলযোদ্ধা গোপাল সরকার। তিনি দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের হলুদবুনিয়ায় বসবাস করেন। দক্ষিণ বেদকাশী গ্রামের চা বিক্রেতা ওবায়দুল হোসেন বলেন, দিন শেষে যে আয় হয় সেটা দিয়ে কোন রকমে তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনতিপাত করি। পানি ওঠায় কয়েক দিন দোকান বন্ধ, প্রতিদিন বাঁধে যেয়ে ফ্রি কাজ করেছি। বাজার করতে পারিনি, খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। তবে বাঁধ মেরামত করতে পেরে তিনি বেজায় খুঁশি। এমন আপসোস শুধু ওবায়দুল কিংবা গোপালের নয়, অবহেলিত কয়রার লাখো মানুষের। ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত। কোথাও বাঁধ ভেঙে গেলে টিকে থাকতে স্বেচ্ছাশ্রম নিজেদেরই ঝাপিয়ে পড়তে হয় পানি আটকানোর জন্য।

বলছিলাম খুলনার কয়রায় উপজেলার অবহেলিত জনপদের প্রাণের আকুতি। ১৩ আগস্ট জোয়ারের পানির চাপে কপোতাক্ষ নদের চরামূখা নামক স্থানের রিং বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই দিন থেকে টানা পাঁচ দিন স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বুধবার (১৭ আগষ্ট) নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। টানা ৪ দিন বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও পঞ্চমদিনে প্রায় ৩ হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমের প্রচেষ্টায় ফের রিং বাঁধ দিয়ে কপোতাক্ষের নোনা পানি আটকাতে সক্ষম হয়েছে। তবে শুধু এবার নয়, প্রতি দুর্যোগের পর এভাবেই ভাঙা বাঁধ মেরামতে স্থানীয় মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হয় বলে জানালেন তারা। এবার বাঁশ- সিনথেটিক ব‌্যাগ চাহিদা মত না পাওয়ায় কাজে চরম ভোগ পেতে হয় বলে অভিযোগ তাদের।

এদিকে, দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নে নদীশাসন ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ ৭ দফা দাবিতে বুধবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এলাকাবাসির পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গোলখালী গ্রামের আশরাফুল ইসলাম নূর।

কপোতাক্ষ নদে নদীশাসন ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা, সাতক্ষীরা পওর ১৩, ১৪/১ ও ১৪/২নং পোল্ডার খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, প্রতিটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রকল্পের সার্বিক বিবরণী টাঙানো বাধ্যতামূলক করা, বেড়িবাঁধ নির্মাণে ঠিকাদার ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা এবং আর্থিক অসাধুপায় অবলম্বনের অভিযোগ উঠলে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিসহ ৭ দফা দাবি করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে, গত ১৭ জুলাই ভোরে চরামুখার এই বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটারের মতো ধসে যায়। সেসময় ভাঙা স্থানে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হয়। এরপর ১৩ আগস্ট দুপুরে উচ্চ জোয়ারে ওই রিং বাঁধটি পুনরায় ভেঙে যায়। এই ভাঙনে কপোতাক্ষের নোনা পানিতে ডুবে যায় ১০টির বেশি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। অভ‌্যন্তরিণ যোগাযোগ ব‌্যবস্থা, মৎস‌্য ঘের, আমনের বীজতলা, বসতবাড়িসহ পরিবেশের চরম ক্ষতি হয়েছে।

বাঁধ মেরামতে আসা লোকজন অভিযোগ করেন, চরামুখার বাঁধটি সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তারা এড়িয়ে গেছে। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের জানালে এ কাজ তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না বলে জানিয়ে দেন। উপজেলা প্রশাসনও একই কথা জানায়। অথচ বাঁধ ভাঙলে বারবার ভুক্তভোগী মানুষকেই তা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হয়।

সোমবার সকলের সাথে বাঁধে কাজ করেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার জিএম মাহবুবুল আলম। কাজের শেষে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাঁশ ও ব্যাগ স্বল্পতায় কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সরঞ্জামাদি দিয়েছিল সেটা যথেষ্ট ছিল না। পর্যাপ্ত মানুষ থাকার পরেও বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওখানকার যাবতীয় কাজ দেখাশুনা করেন ইউপি সদস্য মো. মোজাফ্ফার শিকারী। সরঞ্জামের বিষয়ে তিনি জানান, যথেষ্ট ব্যাগ ছিল। তিনি আরও বলেন, যত খরচ আমিই করেছি এ পর্যন্ত। আমার নিজে হাতেই করেছি। একটা ব্যাগের দাম ৭ টাকা। অপচয় ঠেকাতে হয়ত ছোটদের কাছে ব্যাগ দেয়া হয়নি। আপনি নিজ হাতে কেন খরচ করেছেন? জানতে চাইলে এড়িয়ে তিনি বলেন, নিজের থেকে করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড দিলে দিবে, না দিলে না দিবে। তিনি আরও বলেন, পাউবো সরাসরি ফান্ড দিতে পারে না, ব্যাগ কিনে দিয়েছিল। তাকে ডিপিএম দিলে তার এই খরচ উঠবে বলে জানান তিনি।

সরঞ্জাম সংকটের বিষয়ে সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আছাদুজ্জামান বুলবুল বলেন, পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি না থাকায় কাজে সমস্যা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড তেমন কোন সহযোগীতা করছেন না। নিজেরা স্থানীয়ভাবে অর্থ দিয়ে যতটুকু পারছি সরঞ্জাম কিনে কাজ করছি। একমাস আগেও বেঁধে ছিলাম। মোজাফ্ফার মেম্বারের সাথে তাদের কি আছে জানিনা। মোজাফ্ফার মেম্বারও ব্যাগ কিনতেছেন।

অন্য এক ইউপি সদস্য মো. মাসুদ রানা বলেন, মেম্বার মোজাফ্ফার পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধি। তার মাধ্যমে আমরা সরঞ্জামাদি পাচ্ছি। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম বলে তিনিও স্বীকার করেন।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা নাজমুল জানান, বাঁধ নির্মাণে কাজ করেছি। চাহিদা অনুযায়ী সরঞ্জামাদি দেয়া হয়নি। মোজাফ্ফার মেম্বার ও এক পাউবো কর্মকর্তার সখ্যতা রয়েছে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমরা দেখেছি বিগত ১০ বছরে জরুরী কাজের নামে কয়রার বেড়ীবাঁধ সংষ্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১শ’ ৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি। বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ হয় না। সেখানে রয়েছে অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। টেন্ডারে কাজ পেয়ে মূল ঠিকাদার নিজের লাভটা রেখে কাজটা বিক্রি করে দেন আরেকজনের কাছে। এভাবে হাতবদল হলে কাজের মান খারাপ হতে বাধ্য- এটাই দেখে এসেছি এতদিন।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া, মেদেরচর, ঘড়িলাল বাজার ও চরামুখা এলাকার বাঁধ মেরামতে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কাজটিতে অর্থায়ন করেছে জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা)। দরপত্রের মাধ্যমে ‘অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই কাজটির দায়িত্ব পায়।

প্রতিষ্ঠানটির ঠিকাদার জাকির মোহান্দি। তিনি তার পূর্ব পরিচিত শ্রমিক সর্দার সাতক্ষীরার আক্কাস আলীর কাছে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে লাইসেন্স ভাড়া দিয়েছেন। বিষয়টি শ্রমিক আক্কাস আলী স্বীকার করেছেন। বর্তমানে ওই কাজটি তিনিই করছেন। আর স্থানীয়ভাবে কাজ দেখাশুনা করছেন ওই মোজাফ্ফার মেম্বার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বড় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, সরঞ্জাম ও লোকবল নেই ওই শ্রমিক সর্দারের। কাজের মান ভালো না হওয়ায় চলমান কাজের চরামুখা এলাকার বাঁধ গত ১৭ জুলাই ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাপ্তরিকভাবে ওই কাজের তদারকির দায়িত্বে আছেন পাউবো’র উপ-সহকারি প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন। তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন।

সরঞ্জাম বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অফিস থেকেই সব দিয়েছি। যে কোন দোকান থেকে সব আনতে বলি, পরে যে ঠিকাদার কাজ পাবেন তিনি সব পরিশোধ করেন। পরে মোজাফ্ফার মেম্বারের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, তিনি ওখানের কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এজন‌্য উনাকে দিয়ে করাচ্ছি।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় প্রাথমিকভাবে পানি প্রবেশ রোধ করা গেছে। পাউবো’র পক্ষ থেকে বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য বাঁশ ও জিও ব্যাগ দেওয়া হয়েছিল। এবার পাউবো বাঁধ শক্তিশালী করার কাজ করবে।

এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে চরামুখা গ্রামের খালের গোড়া নামক স্থানে কপোতাক্ষ নদের ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের রিংবাঁধ মেরামত কাজ পরিদর্শন করেছেন খুলনা-৬ আসনের (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু। এসময় তিনি বলেন, সরকার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছেন যেটা একনেকে পাশ হয়েছে, এটার টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া জাইকার অর্থায়ানে ৩৫০ কোটি ব্যয়ে বেঁড়িবাধের কাজ চলমান আছে। এছাড়াও বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসমূহ জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!