খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি
  নরসিংদীতে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় যুবককে গুলি করে হত্যা
  ঘন কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ১০ যানবাহনের সংঘর্ষ, নিহত ১, আহত ১৫
  ব্রাজিলে দুর্ঘটনায় বাসে আগুন, পুড়ে নিহত ৩৮

একটি অপমৃত্যু মামলার তদন্ত

এ এম কামরুল ইসলাম

বরিশাল থেকে বদলিজনিত কারণে ঝিনাইদহ জেলায় যোগদান করলাম। সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় গিয়ে আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। বরিশাল জেলায় গত সাড়ে তিন বছরের অর্জিত সুনাম কোন কাজে লাগলো না। আমি ভেবেছিলাম এক, হলো তার বিপরীত। পুলিশের চাকরিতে সুনাম বদনামের চেয়ে অন্য কিছুর মূল্যায়ণ বেশি তা সামান্য উপলব্ধি করলাম। আমার এক ব্যাচমেট একদিন আমাকে বলেছিল, ‘পুলিশের চাকরি হচ্ছে ব্যবসার মতো। বুঝেশুনে জায়গামতো ইনভেস্ট করতে পারলে লাভ বেশি হবে’।

আমি তার কথা বুঝতে পারলেও, তার কথামতো কাজ করতে চাইনি। সুতরাং যা হবার তাই হলো। কয়েক ঘাটের পানি খেয়ে আমার পোস্টিং হলো ঝিনাইদহ জেলা বিশেষ শাখায়। এই শাখার কাজকর্ম আমি কিছুই জানতাম না। তাই মন খারাপ হলেও, বাধ্য হয়েই সেখানে যোগদান করলাম।

আমার পূর্ব পরিচিত জনাব সিরাজুল ইসলাম সাহেব ছিলেন কোর্ট ইন্সপেক্টর। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন এবং জোর করে রেখে দিলেন। তাঁর স্ত্রীকে দেখে ভাবি ডাকলেও মায়ের মতো মনে হলো। তাঁর তিন ছেলে পাইলট, প্রিন্স, টমাস ও এক মেয়ে জু্ঁই আমার ভীষণ ভক্ত হয়ে পড়লো। আমি ঝিনাইদহ জেলার বিশেষ শাখায় মাস দুয়েক কর্মরত ছিলাম। সেখানে চাকুরি করাকালীন আমি এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁর বাসায় থেকেছিলাম। তাদের সাথে আজও আমার পারিবারিক সম্পর্ক অটুট আছে।

মন খারাপ করে ঝিনাইদহ জেলা বিশেষ শাখায় থাকাকালীন একদিন কাউকে না জানিয়ে খুলনা গিয়ে ডিআইজি মহোদয়ের সাথে দেখা করলাম। তিনি সব কথা শুনে একটু রেগে গেলেন এবং আমাকে বললেন, ‘তুমি ঝিনাইদহ চলে যাও, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ঐ জেলা পরিদর্শন করবো’। তখন খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন জনাব এ এফ কবির। যিনি আমার সারদা ট্রেনিংয়ের সময় সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি আমাকে দারুণ স্নেহ করতেন এবং আমার অনেক উপকার করেছিলেন।

আমি যথারীতি ঝিনাইদহ চলে গেলাম। একদিন ডিআইজি মহোদয় ঝিনাইদহ জেলা পরিদর্শনে গেলেন। ঐ দিনই আমার পোস্টিং হলো ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু থানায়। তখন হরিণাকুন্ডু থানায় কোন ওসি ছিলেন না। অতএব আমাকে অলিখিত ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রেরণ করা হলো।

তখন ছিল বর্ষাকাল। হরিণাকুন্ডু থানার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল চরম বেহাল। তবুও আমার যাবতীয় মালামাল একটি সুটকেসে ভরে হরিণাকুন্ডু থানার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। যাবার সময় দুই মাসের মায়ায় জড়ানো কোর্ট ইন্সপেক্টর জনাব সিরাজুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে যেতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল।

অবিশ্বাস্য কাদার রাস্তা পাড়ি দিয়ে হরিণাকুন্ডু থানায় হাজির হলাম। থানার পরিবেশ ও অফিসার ফোর্সের অবস্থা দেখে মনে হলো, চাকরি ছেড়ে আজই চলে যাই। আমার পূর্বের কর্মস্থল বরিশাল কোতোয়ালি থানার জন্য মনটা কেঁদে উঠলো।

তখন হরিণাকুন্ডু থানায় আমি ছাড়া আর একজন সাব ইন্সপেক্টর ও দুই জন সহকারী সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন। তাদের অবস্থা থানার চেহারার মতোই। ঝিনাইদহ জেলার সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত থানা ছিল হরিণাকুন্ডু থানা। বিশেষ করে বৃষ্টির মওসুমে থানায় কোন লোকজন আসতো না, দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকতো না, কোনো টেলিফোনের ব্যবস্থা ছিল না।

দুই/ তিন দিন চলে গেল। আমার কষ্ট বাড়তে লাগলো। হঠাৎ একদিন বৃষ্টিভেজা সকালে একজন চৌকিদার এসে জানালো, থানার প্রত্যন্ত এলাকায় একজন গরীব মহিলা গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাদের পরিবারের কেউ লাশের দায়িত্ব নিয়ে থানায় খবর দিতে চাচ্ছে না, আবার এলাকার চেয়ারম্যান পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া লাশ দাফন করতে দিচ্ছে না।

আমি ডিউটি অফিসারকে চৌকিদারের মাধ্যমে একটি অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করতে বললে, ডিউটি অফিসার গড়িমসি শুরু করলেন। থানার অন্য একজন সাব ইন্সপেক্টর অপমৃত্যুর খবর শুনে আগেই ভিন্ন কাজের অজুহাতে থানা থেকে সরে পড়েছিলেন। ডিউটি অফিসার ছিলেন একজন এএসআই। অতএব বাকি রইলো অপর একজন এএসআই। তিনি জানালেন যে, গতমাসে তিনি অনেক অপমৃত্যু মামলা তদন্ত করেছেন, তাই এই মামলাটি যেন তার ঘাড়ে না দেওয়া হয়।

থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে সকলেই চাইলেন, চৌকিদার সাহেবকে কৌশলে বিদায় দিয়ে ঝামেলা এড়াতে। এই থানায় আত্মহত্যার পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এমন ঘটনা নিত্যকার ছিল। তাই পুলিশ ও আত্মহত্যাকারীর আত্মীয় স্বজনের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। গ্রাম এলাকায় কোন মানুষ আত্মহত্যা করলে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারের খবরদারী ও পুলিশের ভয়ে আত্মীয় স্বজনের কান্না পর্যন্ত থেমে যেতো। কারণ, পুলিশে খবর দিলে জেলা সদরে লাশ মর্গে নেওয়ার খরচ, সেখানে পোস্টমর্টেম করানোর খরচ, আবার বাড়ি আনার খরচ সবই মৃতের আত্মীয় স্বজনদের বহন করতে হতো। তারপর পুলিশের মামলা নিষ্পত্তির ঝামেলা তো আছেই। এসব কারণে আত্মহত্যাকারী নিজে মরে, আত্মীয় স্বজনের বোঝা হয়ে পড়তো।

এসব ঘটনায় পুলিশেরও অনেক বক্তব্য শুনেছি। তারা জানান, পুলিশ যদি দায়িত্ব নিয়ে মৃতের বৈধ অভিভাবকদের কাছে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দেয় তাহলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী অফিসারের বিপদ হয়। কারণ, অনেক সময় প্রকৃত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, আবার প্রকৃত আত্মহত্যাকে হত্যা মামলা সাজানোর চেষ্টা করা হয়। তখন পুলিশের সমস্যা হয়। তাই কোন পুলিশ অফিসার সহজে অপমৃত্যু মামলা তদন্ত করতে চান না। নিদেনপক্ষে তদন্ত করতে বাধ্য হলে, প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে প্রকৃত আত্মহত্যার ঘটনায়ও সোজা পোস্টমর্টেম করতে মর্গে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে কে ধনী, কে গরীব, কোন ঘটনা প্রকৃত আত্মহত্যা, কোন ঘটনায় পরবর্তীকালে সমস্যা হতে পারে, আর কোন ঘটনায় সমস্যা হবে না, সে বাছবিচার অধিকাংশ তদন্তকারী অফিসারের মাথায় থাকে না।

যাহোক, চৌকিদারের মৌখিক ভাষ্যমতে আমি নিজেই অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করে নিজেই তদন্তভার নিলাম এবং একজন কনস্টেবল সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলাম।

গ্রামের কর্দমাক্ত পথে বৃষ্টিতে ভিজে মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে গিয়ে বহুবার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কাকভেজা হয়ে এক সময় মৃতদেহের কাছে পৌঁছে গেলাম। একটি মাটির একচালা ঘরের ভাঙাচোরা বারান্দায় মৃতদেহটি পড়েছিল। সারারাতের বৃষ্টি মৃতদেহকে এক প্রকার শেষ গোসল করিয়ে রেখেছিল। যে ঘরটিতে মৃত্যুর আগে মৃত মহিলা স্ব-পরিবারে বসবাস করতেন তার ঘরে বৃষ্টি ঠেকানোর উপযোগী ছাউনি ছিল না। অতএব ঘরে ও বারান্দায় বৃষ্টির পানি অনায়াসে বয়ে চলতো। তাদের নিজেদের কোন ঘরবাড়ি ছিল না। নদী ভরাটের সুযোগে কোনমতে একটু জায়গা দখল করে ছিল তাদের বসবাস ।

আমি ঐ বাড়িতে পৌঁছে দেখি সমগ্র বাড়ি জনমানবহীন। এমনকি এলাকার কোন মানুষও তেমন চোখে পড়লো না। মৃতের বয়স ছিল অনুমান ২৫/৩০ বছর। স্বামী ও দুটি সন্তানও ছিল। পুলিশ আগমনের খবর শুনে স্বামী আগেই পালিয়েছিল, সন্তান দুটি কান্না ভুলে পাশের কোন নিরাপদ স্থানে গা-ঢাকা দিয়েছিল। এসব ঘটনায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদার, দফাদারদের কিছু আইনগত দায়িত্ব থাকে। কিন্তু বৃষ্টির অজুহাতে ও মৃত অত্যন্ত গরীব বিধায় সকলেই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিল।

আমি লাশটি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। যে ঘরের মধ্যে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সেই জায়গা দেখলাম। মৃতার গলায় রশির দাগ ও আত্মহত্যার সকল উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করলাম। সবকিছু মিলিয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে, এটা প্রকৃতই আত্মহত্যা। কিন্তু, তার আত্মহত্যার পিছনে কী কারণ ছিল তা জানা আবশ্যক ছিল। তাই আমি সেই কারণ খুঁজতে চেষ্টা করতে থাকলাম। কিভাবে করবো? সেখানে কোন লোকজন সাক্ষ্য দেওয়া দূরের কথা, আমার সাথে সামান্য কথা বলতেও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আমি অসহায়ের মতো মৃত্যুর কারণ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু কোন ফল হলো না। মৃতার স্বামী ও সন্তানের কোন হদিস পাওয়া গেল না। আমার সাথে থাকা কনস্টেবলকে দিয়ে পার্শ্ববর্তী লোকজন খুঁজে আনার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত কাগজ কলম নিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করলাম। কোন মহিলার লাশের সুরতহাল করার সময় আইন অনুযায়ী একজন মহিলা দ্বারা লাশ উলোটপালোট করে সমস্ত শরীর দেখার নিয়ম আছে। কিন্তু তেমন কোন মহিলা না পাওয়ায় বাধ্য হয়েই সেই বেআইনী কাজটি আমাকেই করতে হলো।

লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী হলো। এবার সুরতহাল রিপোর্টে কয়েকজন সাক্ষীর স্বাক্ষর নেওয়ার পালা। কিন্তু আবারও সেই একই সমস্যা। কে দেবে স্বাক্ষর? আমার সাথে থাকা কনস্টেবলকে স্বাক্ষর দিতে বলায় সে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর দিল। ইতোমধ্যে সময় অনেক গড়িয়ে গেল। বৃষ্টি থেমে গেল। পুলিশের ভীতি কাটিয়ে দুই-চারজন মানুষের চলাফেরা লক্ষ্য করা গেল। তাদেরকে সুরতহাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করার জন্য অনুরোধ করলে তারা কৌশলে সরে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আমার অসহায়ত্ব বাড়তে লাগলো।

এখানে একটা আইনের কথা বলে রাখি। ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ১৭৪ ধারা অনুযায়ী অপমৃত্যু মামলা তদন্তের সময় কোনো মানুষ পুলিশের অনুরোধে কোন মৃত ব্যক্তির সুরতহাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তাকে তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় প্রসিকিউট করার ক্ষমতা রাখে। এই আইন আমার জানা ছিল। সন্দেহজনক আত্মহত্যার ঘটনায় মৃতার স্বামী বা সন্দেহজনক কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পুলিশ হিসেবে আমারও ছিল। কিন্তু কোনো আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করার মানসিকতা আমার মনে আসেনি। শুধু, ঐ অসহায় মৃতদেহের প্রতি আমার মানসিক কষ্ট বেড়েই চললো। তাই, দুই তিনজন অশিক্ষিত পথচারীর কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টিপসই নিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট সম্পন্ন করলাম।

সাথে থাকা কনস্টেবল বললে, ‘স্যার, এই লাশ কিভাবে বয়ে সদর হাসপতালে নিবো? এখানে কোন ভ্যান বা অন্য কোন বাহন পাওয়া যাবে না। চেয়ারম্যান, মেম্বাররা কোন সাহায্য করবে না। আত্মাহত্যার লাশ নেওয়ার কথা শুনে এলাকার সকল ভ্যানওয়ালা এই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি এখন কী করবো? আমার কাছে কোন টাকা পয়সাও নেই’।

এখানে আরো একটা আইনের কথা বলি। অপমৃত্যু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন, আত্মহত্যার পিছনে কোন হত্যাজনিত বা সন্দেহজনক কারণ নেই; অর্থাৎ মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত আত্মহত্যা, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা লাশের বৈধ অভিভাবকদের কাছে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন। আবার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজের ভবিষ্যৎ ঝামেলা এড়াতে, বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়ের লিখিত অনুমতি নিতে পারেন। একজন এএসআই থেকে সকল উর্ধতন পুলিশ অফিসার অপমৃত্যু মামলা তদন্তের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হলো। পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ সদর হাসপাতালে পাঠাতে হবে, না হয় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে নিজে ঝুঁকি নিয়ে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দিতে হবে। প্রথমোক্ত দুটি পথ আমার জন্য ঝুঁকিমুক্ত হলেও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং শেষোক্ত পথটিতে সকল ঝুঁকি আমার নিজের উপর। সুতরাং আমি শেষোক্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সিদ্ধান্তে সঙ্গীয় কনস্টেবলের মুখে স্বস্তি ফিরে এলো, এলাকার লোকজন এগিয়ে আসতে লাগলো। শুধু, মৃতের স্বামী ও সন্তানদের দেখা মিললো না।

উপস্থিত লোকজন একে একে বলতে লাগলো মৃতার আত্মহত্যার মূল রহস্য। মৃতার স্বামী বেচারা ছিল দিনমজুর, তবে একটু অলস। মৃতা নিজেও দিনমজুর ছিল। দুজনেই মাটি কাটার কাজ করতো। যখন কাজ থাকতো তখন খাবার থাকতো। বর্ষাকালে মাটির কাজ কম হয়। তারপর কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কোন কাজ ছিল না। তাই তাদের খাবার জোটেনি। দুটো ছেলেমেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করছিল। ছেলেমেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে মহিলা আত্মহত্যা করেছিল। স্বামী বেচারা পুলিশের ভয়ে কোথায় পালিয়েছিল তা কেউ বলতে পারলো না।

সবকিছু শুনে আমার পুলিশি মনটা মানুষের রূপ ধারণ করলো। ওদিকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমিও অভুক্ত ছিলাম। ঐ এলাকায় খাবার মতো কোন জায়গা ছিল না। আশেপাশের কোন বাড়ি থেকেও খাবার প্রস্তাব এলো না। পকেট থেকে টাকা বের করে খাবার কিনতে কাউকে পাঠাবো এমন ব্যবস্থাও ছিল না। সময়টা ছিল ১৯৮৮ সাল। অতএব তখনকার কথা সহজেই অনুমান করা যায়। শেষ পর্যন্ত নিজের টাকায় মৃতার জন্য কাফনের কাপড় আর বাঁশ কিনতে পাঠালাম। স্থানীয় একজনকে দাফন কাফনের দায়িত্ব দিয়ে সন্ধ্যায় থানার উদ্দেশ্য মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম।

রাতে থানায় ফিরে ঐ থানায় পোস্টিং দেওয়ার জন্য এসপি মহোদয়কে মনে মনে অভিসম্পাত দিতে থাকলাম এবং ঐ এলাকায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণ খুঁজতে শুরু করলাম। অপমৃত্যু মামলার রেজিস্টার ঘেটে দেখলাম সারা দেশের তুলনায় ঝিনাইদহ জেলায় অপমৃত্যু মামলার পরিমাণ অনেক বেশি। পুরনো কয়েকজন কনস্টেবলের কাছে জানলাম, আরো অনেক আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হয় না। আবার কিছু আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হলেও ঝামেলা এড়াতে নথিভুক্ত করা হয় না। সবকিছু শুনে মনে মনে স্থির করলাম, এখানে চাকরি করাকালীন আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু কিছু কাজ করবো এবং এই মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট লেখার সময় গতানুগতিক চূড়ান্ত রিপোর্ট না লিখে, আমার অভিজ্ঞতার কথা পুলিশ বিভাগ ও সরকারের উচ্চ মহলে জানানোর চেষ্টা করবো।

পরদিন সকালে অপমৃত্যু মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট লিখতে বসলাম। এর আগে বিভিন্ন অফিসারের দাখিলকৃত চূড়ান্ত রিপোর্ট পড়লাম। সবটাই ছিল ছক আকারে ও একান্তই দায়সারা। আমি ছকের বাইরে আমার কিছু কিছু অতিরিক্ত মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলাম। ভেবেছিলাম হয়তো কোনোদিন আমার ঐসব মতামত কোন বড় কর্তার নজরে পড়তে পারে। তবে পুলিশের ঐসব দেখার সময় নেই তাও আমি জানতাম। আমি ঐ ঘটনায় যা যা করেছিলাম এবং যা যা লিখেছিলাম তা সবই আমার একান্ত নিজের তৃপ্তির জন্য। আমার মনে হয়, আমার সেই লেখা শুধু লেখাই রয়ে গেছে। তবে, ঐ অপমৃত্যু মামলায় ঝুঁকি নিয়ে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়ার কারণে আমার কোন ঝামেলা হয়নি।

ঐদিন দুপুর পর্যন্ত মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট লিখে খাওয়া দাওয়া করে থানায় ঘুমিয়ে ছিলাম। বিকাল বেলায় ওয়ারলেস অপারেটর আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, ‘স্যার, আপনার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে বদলি হয়েছে। এসপি মহোদয় আপনাকে আজই ডিপার্চার রিপোর্ট দিতে বলেছেন। কারণ আইজিপি মহোদয় নিজে সারা দেশ থেকে বেছে বেছে চৌদ্দ জন সাব ইন্সপেক্টরকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে বদলি করেছেন। বদলির আদেশ হয়েছে ৮/৮/৮৮ তারিখে, কিন্তু আমাদের এখানে আদেশ আসতে একটু দেরি হয়েছে। কারণ আপনার বদলির আদেশ বরিশালে চলে গিয়েছিল। ওখান থেকে আবার ঝিনাইদহ জেলায় এসেছে’।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কেমন হবে তা আমি জানি না। তবে ঝিনাইদহ জেলার প্রতিকূল অবস্থা ও হরিণাকুন্ডু থানার অসহায়ত্বের অবসান হওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।

আনন্দ

অপমৃত্যু মামলায় আনন্দের কোন কারণ থাকার কথা নয়। তবুও আত্মহত্যাকারী ঐ মহিলার মৃতদেহকে কষ্ট না দিয়ে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফন প্রক্রিয়ায় কিছুটা অবদান রাখায় একটু ভাল লেগেছিল।

অপমৃত্যু মামলা তদন্তের সময় আইনগত সহায়তা দিতে বাধ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ আমাকে সহায়তা না করায় তাদের বিরুদ্ধে আমি কোন আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ না করে হয়তো ভালোই করেছিলাম।

মৃতার স্বামীকে ইচ্ছে করলেই আমি অন্ততপক্ষে ভয় দেখাতে পারতাম, তাও আমি করিনি।

হয়তো এসব কারণে ঘটনার পরের দিনই আমার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে বদলির আদেশ এসেছিল; আমার চাকরি জীবনে ঐ বদলি ছিল টার্নিং পয়েন্ট।

বেদনা

ঐ ঘটনার পুরোটাই বেদনায় ভরা। সারা জীবন পুলিশের চাকরিতে আমাকে যতগুলো ঘটনা কাঁদায় তার অন্যতম একটি ঘটনা ছিল ঐ মহিলার আত্মহত্যার মামলাটি। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!