খুলনা, বাংলাদেশ | ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলায় ৩ পুলিশ বরখাস্ত, গ্রেপ্তার ৭
  ভারতীয় সব বাংলা চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ চেয়ে করা রিটের শুনানি বুধবার

একজন বর্ণহীন উজ্জ্বল শিক্ষক

‌নিজস্ব প্রতি‌বেদক

এলপিআর এ যাবার পর প্রফেসর আখতার নিজের লেখা সর্বশেষ বই চবি ভিসি প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে উপহার দিচ্ছেন।
এলপিআর এ যাবার পর প্রফেসর আখতার নিজের লেখা সর্বশেষ বই চবি ভিসি প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে উপহার দিচ্ছেন।
এলপিআর এ যাবার পর প্রফেসর আখতার নিজের লেখা সর্বশেষ বই চবি ভিসি প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে উপহার দিচ্ছেন।

যে সকল সম্মানিত শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশে এবং বিদেশে অধিকতর পরিচিত ও আলোকিত করেছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার তাদের মধ্যে একজন। এ বছর মার্চ মাসে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন আয়োজিত বরেণ্য শিক্ষাবিদদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে ড. আখতার প্রদত্ত বক্তব্য দেশে-বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। ওই বক্তব্যে অধ্যাপক আখতার সুশীল সমাজকে বুঝিয়ে দেন যে, দেশ ও জাতির স্বার্থে শিক্ষাবিদদের কেমন ভূমিকা পালন করা উচিত।

প্রফেসর আখতার ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চার দশক শিক্ষকতা করেন। সম্প্রতি গত ২৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ছিল ড. আখতারের শিক্ষকতা জীবনের শেষ কর্মদিবস। এ উপলক্ষে আমরা শিক্ষার্থীবান্ধব ও জনপ্রিয় এ শিক্ষকের সঙ্গে অনলাইনে কথা বলি। তিনি সানন্দে আমাদের কতিপয় প্রশ্নের উত্তর দেন।

খুলনা গেজেট : স্যার, কয়েকদিন আগে ২৭ অক্টোবর আপনার দীর্ঘ চার দশকের শিক্ষকতা জীবন শেষ হল। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

প্রফেসর আখতার : আমার অনুভূতি ইতিবাচক। চার দশক শিক্ষকতা করে সুস্থ্য শরীরে এল. পি. আর বিশ্রামে যেতে পারছি। এ জন্য আমি আনন্দিত। ২৭ অক্টোবর দিনটিকে আমি আমার জীবনের একটি উজ্জ্বল দিন হিসেবে বিবেচনা করব। এই ৪০ বছরে সযত্ন শিক্ষাদান এবং একাডেমিক গবেষণার পাশাপাশি আমি লেখালেখির মাধ্যমে সীমিত সামর্থের মধ্যে থেকে নিজেকে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশে-বিদেশে পরিচিত করাতে চেষ্টা করেছি। হয়তো যতটা চেয়েছি ততটা পারিনি। যদি কিছুটাও পেরে থাকি, সে জন্য আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া জানাই।

খুলনা গেজেট : শিক্ষক হিসেবে আপনি সব সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। এই জনপ্রিয়তার রহস্য কি?

প্রফেসর আখতার : দেখুন, বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। এর মধ্যে কোনো রহস্য নেই। শিক্ষক যদি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন, শিক্ষার্থীদের ভালোবাসেন, তাদের নিজ সন্তানের মতো বিবেচনা করেন, তাহলে কেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে ভালোবাসবেন না? কেন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হবেন না? আমি শিক্ষার্থীদের যত্ন করে পড়িয়েছি। সব শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখিছি। তাদের সময় দিয়েছি। ভালোবেসেছি। সে জন্যই হয়তো তারা আমাকে পছন্দ করেন। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে, ছাত্রছাত্রীরাই হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা। তারা আছেন বলেই আমরা শিক্ষক। সে জন্য শিক্ষকের প্রথম কাজ হল শিক্ষার্থীদের আন্তরিকভাবে সহায়তা করা। জনপ্রিয় হবার জন্য শিক্ষকের পৃথকভাবে কিছু করা লাগে না। নিষ্ঠার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে জনপ্রিয়তা এমনিতেই অর্জিত হয়ে যায়।

খুলনা গেজেট : সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লেখাপড়ার মান দিনদিন কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এ বিষয়ে কিছু বলবেন কি?

প্রফেসর আখতার : দেখুন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান। এটি অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না। একাডেমিক প্রতিষ্ঠান যদি রাজনৈতিক প্রভাবে বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তাহলে তার একাডেমিক মান বাড়বে কেমন করে? আমার বিবেচনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির চর্চা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা।

খুলনা গেজেট : তাহলে কি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করে দিতে বলছেন?

ড. আখতার : না আমি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিতে বলছি না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির চর্চা বন্ধ করতে পরামর্শ দিচ্ছি। ছাত্র এবং শিক্ষকগণ ক্যাম্পাসে তাদের একাডেমিক স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি করবেন। জাতীয় দলীয় রাজনীতি করবেন না। ছাত্র রাজনীতির সোনালী অতীতকে স্বীকার করে বলছি, ছাত্র রাজনীতি আর এখন ছাত্র রাজনীতি নেই। এ রাজনীতি এখন ছাত্র ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হল দখল, সিট দখল, মনোনয়ন বাণিজ্য, পদ কেনাবেচা, র‌্যাগিং, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, গেস্টরুম সংস্কৃতি, টর্চার সেল, যৌন অপরাধ ও আরও নানা রকম কুকর্ম এখন ছাত্র রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুলে গেলে হবে না, পৃথিবীর সব দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখানেও ছাত্র-শিক্ষক আছেন। তাদেরও সংগঠন আছে। ওই সব সংগঠন ছাত্র-শিক্ষকদের একাডেমিক স্বার্থ নিয়ে বার্গেনিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে না।

খুলনা গেজেট : অতি সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও ছাত্র রাজনীতি চালু করার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

প্রফেসর আখতার : কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন, ব্রাক, নর্থ সাউথ, প্রভৃতি ভালো করছে। এ রকম কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো গ্রাজুয়েট তৈরি হচ্ছেন। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র রাজনীতি চালু করা হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও বারোটা বাজবে। আমি মাননীয় মন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী এবং শিক্ষাঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করব। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সবিনয়ে এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করব।

খুলনা গেজেট : আপনাদের মত সিনিয়র শিক্ষকগণ অবসরে চলে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি একাডেমিকভাবে হালকা হয়ে যাচ্ছে না? কি বলবেন?

প্রফেসর আখতার : আমি তা মনে করি না। সিনিয়ররা চলে যাবেন। নতুন জুনিয়র শিক্ষকগণ সে শুন্যতা পূরন করবেন। এটাই নিয়ম। তবে এ জন্য শিক্ষক নিয়োগে ফেয়ার প্লে নিশ্চিত করে যোগ্যদের অনুপ্রবেশ সুনিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের কারণে অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের কাজটি পেশাদারিত্বের সঙ্গে সংঘটিত হচ্ছে না। যেখানে একজন স্কুলশিক্ষক হতে হলে নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসসহ কয়েক রকম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, সেখানে কেবলমাত্র একটি নামকাওয়াস্তের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক নিয়োগ কতটা যৌক্তিক হচ্ছে? এ জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশক্ষেত্রে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিকভাবে হালকা হয়ে যাচ্ছে। এটি অবশ্যই গভীর দুঃশ্চিন্তার বিষয়।

খুলনা গেজেট : সম্প্রতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইদ এবং কতিপয় শিক্ষকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম-এর চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনলাইনে প্রচারিত অনুষ্ঠানে আপনি নিজেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক হাজার শিক্ষকের মধ্যে সবচেয়ে কম অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এমনটি কেন?

প্রফেসর আখতার : হ্যাঁ আমি এমন কথা বলেছি। কারণ, দুঃখের সাথে বলতে হয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব রকম পদ ও সুযোগ সুবিধা রাজনৈতিক বিবেচনায় বন্টিত হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বর্ণের আবরণে প্রচলিত দলীয় রাজনীতিতে জড়িত নই। এ কারণে আমার ৪০ বছরের শিক্ষকতাজীবন ক্লাসরুমকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। বর্ণহীন হওয়ায় অন্য কোনো পদে কাজ করার সুযোগ হয়নি। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন এবং অন্য অনেক বিষয়ে আমার জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। এ দৃষ্টিকোন থেকে আমি এমন কথা বলেছিলাম।

খুলনা গেজেট : স্যার, শিক্ষাজীবনের শেষ কর্মদিবসে আপনি যদি কিছু বলতে চান, বলতে পারেন্।

প্রফেসর আখতার : আমার তেমন কিছু বলার নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বিভিন্ন বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত হয়ে ধ্বংসের কার্ণিশে উপনীত, তেমন সময়ে সুস্থ্য শরীরে সাফল্যের সাথে শিক্ষকতাজীবন শেষ করতে পেরে আমি আনন্দিত। এ জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রিয় শিক্ষার্থীদের বলতে চাই, সতর্কতার সাথে পথ চলুন। নিজের জীবন নিজেই গড়তে হবে। বেশি করে বই পড়তে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। সাফল্য এক সময় অবশ্যই আসবে। আমি আন্তরিকভাবে আমার সকল সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করি। আমার নিজের জন্য তাদের কাছে দোয়া চাই।

খুলনা গেজেট : আপনার অবসর জীবন কিভাবে কাটাবেন?

প্রফেসর আখতার : যা সব সময় করি, তাই করব। আপনাদের দোয়ায় সুস্থ্য থাকলে কিছু লেখালেখি করার ইচ্ছে আছে। এ ছাড়া আমাকে কিছু বৈষয়িক কাজ করতে হবে। বৈষয়িক বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম। এর মধ্যে সময় পেলে দেশে এবং বিদেশে আমার ছাত্রছাত্রীদের দেখতে যাবো। সম্ভব হলে অজ পাড়াগাঁয়ে যে সব ছাত্রছাত্রী থাকেন, তাদের কাছে বেড়াতে গিয়ে তাদের চমকে দেব। এ সব করতে করতে সময় চলে যাবে।

খুলনা গেজেট : আমরা আপনার অবসরজীবনের সাফল্য কামনা করি। আমরা চাই আপনি দেশ ও জাতির কল্যাণে আরও লিখুন। আরো কর্মময় হোক আপনার অবসর জীবন। আমাদেরকে সময় দেবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

প্রফেসর আখতার : আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন। আমাকে মোনাজাতে রাখবেন।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!