খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা ৬ মামলা বাতিল করেছে হাইকোর্ট
  জুলাই-আগস্টে হত্যা : সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি মেহেদীর জামিন স্থগিত
  সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা

একজন ফরহাদ হোসেন এবং একটি পঁচা কাঁঠালের গল্প

শেখ নিজাম উদ্দিন আহমেদ

ভরা আষাঢ়।
তিনদিন ধরে অঝোর ধারায় ঝরছে বর্ষা। কখনো সবিরাম, কখনো অবিরাম। পশুপাখি এবং দিন- খাটুনেওয়ালারা অর্ধাহার ও অনাহারে রাত-দিন, দিন-রাত পার করছে।

কেউ যে একটু বের হবে এর জো নেই। বৈশ্বিক অতিমারী ‘করোনার’ প্রাদূর্ভাবে এমনিতেই জনজীবন বিপর্যস্ত, বিপন্ন। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে চলছে সাট-ডাউন, লক-ডাউন, কারফিউ সহ নানা বাধা নিষেধ। ধনী দেশগুলোর জনগন অনাহার বা চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত নয়। সরকার ও জনগন একটা নিয়মের মধ্যে তাদের নীতি ধ্যান-ধারনা সমৃদ্ধ করেছে। ফলে কাউকে অভুক্ত রেখে নিজেরা বিত্তশালী হবে এমন দর্শনে তারা কম বিশ্বাস করে। শতভাগ না হলেও সুষম বন্টন ব্যবস্থা জনগণের দ্বার প্রান্তে পৌছে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র থেকে বরাদ্ধ করা খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তাদের নিকট পৌছে যায়। এতে লক-ডাউন দীর্ঘস্থায়ী হলেও জনসাধারণের মৌলিক চাহিদার ঘাটতি হয় না। ঘাটতি হয় পানশালা, ক্যাসিনো এবং ব্রোথেলে যাওয়ার।

করতোয়ার পাশেই ঝুমঝুম পুর গ্রাম। ফরাদ হোসেন ঐ গ্রামের একজন ভূমিহীন বাসিন্দা। শুধু বাস্তুভিটা সম্বল। নদীর ভাঙ্গনে বিঘা তিনেক ধান চাষের জমি বিলীন হয়েছে কয়েক বছর হলো। এরপর থেকে নিত্য খাটুনির উপর সংসার চলে।

ফরহাদ হোসেন ফর্সা ও ঢেঙা, প্রশস্ত ছাতি। পেটানো কলেবর। বছর ছয় হলো বিয়ে করেছে। বউটা এক কথায় সুন্দরী। ওদের দুটি বাচ্চা। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলেটির বয়স বছর চারেক আর মেয়েটি সবে মাত্র ১ বছর তিন মাসে পড়লো।

টিপ টিপ কখনো ঝর ঝর বৃষ্টি পড়ছে অনবরত। তিনদিন হলো একই অবস্থা। ওদিকে লক-ডাউন। সরকার বলছে অটো রিক্সা চলবে। পুলিশ বলে চলবে না। ফরহাদ হোসেন বুঝে পায়না কে বড়- সরকার না পুলিশ ?

ফরহাদের কাছে পুলিশই বড়। পুশিলতো দেখা যায়, এ্যাকশান নেয় ঝটপট। সরকারতো দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে ভাবে পুলিশই সরকার হবে। নইলে পুলিশ সরকারের কথা শুনে না কেন ?
সে যাক গে। কে বড় সে পরের কথা। এখন ওর কাছে সবচেয়ে বড় ক্ষুধা। চারটে প্রাণি কয়েকদিন ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে। বাচ্চা দুটো ক্ষুধায় কান্নাকাটি করছে। ফরহাদ হোসেনের সুন্দরী বউ মুনিয়া কিছু শাক-পাতা যোগাড় করে সিদ্ধ করছে বাচ্চাদের প্রবোধ দেওয়ার জন্য।

ফরহাদ হোসেন বুকে সাহস ভর করে ভ্যান গাড়ীটি নিয়ে রাস্তায় নামে। রাস্তা ফাঁকা। তেমন যাত্রী নেই। রাত্রি এখন আটটা। মাত্র দশ টাকা রোজগার করেছে। দুটো বনরুটি কিনেছে আট টাকা দিয়ে। দুটাকা অবশিষ্ট। রুটিদুটো লুঙ্গির খুটে পেচিয়ে কোমরে সযতেœ রেখেছে। ফেরার কালে রেল ষ্টেশনের পাশে একটা পচা কাঁঠাল দেখতে পেলো। পরীক্ষা করে দেখলো ফরহাদ হোসেন। কাঁঠাল খাওয়া যাবে না, কিন্তু বিচিগুলো সেদ্ধ করে খাওয়া যাবে। তাই কাঁঠালটি ভ্যানের উপর রেখে একটি চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিলো।

আকাশে মেঘ আনাগোনা করছে। তবে বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় আলো নেই। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার রাস্তা নয় এটি। ফরহাদ হোসেন লক্ষ্য করল দূরে কয়েকজন পুলিশ একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে। এরা টহল পুলিশ হবে। ফরহাদ পুলিশকে ভয় পায়। লক-ডাউনে ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছে, পাছে জেল জরিমানা করে এই ভয়। ফরহাদ হোসেন জানে আকাশের তারা যত, পুলিশের ধারা ততো। তাই সে ভ্যান আবার রেল স্টেশনের দিকে ফিরিয়ে নেয়। পুলিশ লক্ষ্য করে বাঁশি বাজায় এবং ফরহাদ হোসেনকে কাছে আসতে বলে। উপায় নেই। ফরহাদ হোসেন থরথর শরীরে ভ্যান নিয়ে পুলিশের নিকট এলো। পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলো- তুমি এদিকে আসছিলে, হঠাৎ ভ্যান ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিলে কেন ? ফরহাদ হোসেন বলে- স্যার পুলিশ আমার অনেক ডর করে তাই।

কোচড়ে কি ? স্যার- দুটো বাচ্চার জন্য বনরুটি কিনেছি। স্যারগো ওরা তিনদিন পেটভরে কিছু খেতে পায়নি। খিধায় অনেক কান্নাকাটি করছে। বাপ হয়ে ক্যামনে চুপ করে থাকি। ওদের কান্না সহ্য করতে না পেরে চুপি চুপি এ ভ্যান নিয়ে রাস্তায় এসেছি। যদি প্যাসেঞ্জার পাই। এক কেজি চাল আর কিছু আলু কিনব এ আশায়। কিন্তু কোন প্যাসেঞ্জার পেলাম না।

পুলিশ অফিসার তন্ময় হয়ে ওর রোদন-আঁখির বেদনা ভরা বর্ণনা শুনছিলো। বললো- তোমার ভ্যানের উপর বস্তায় ঢাকা ওটা কি ? একজন কনস্টেবলকে বস্তাটি সরাতে বললো। বস্তা সরালে পঁচা কাঁঠালের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলো- এ পঁচা কাঁঠাল কী করবে নিয়ে ? এতো খাওয়া যাবে না। অসুখ করবে। একজন কনস্টেবলকে কাঁঠালটি বিলের মধ্যে ফেলে দিতে বললো। ফরহাদ হোসেন অশ্রুশিক্ত কন্ঠে অফিসারের হাত ধরে অনেক অনুরোধ করল- স্যারগো কাঁঠালটি ফেলবেন না। আমার বাচ্চারা না খেয়ে আছে। আমরা কাঁঠাল খাবোনা, ওর বিচিগুলো ভালো আছে। ওদের মা কাঁঠালের বিচিগুলো সিদ্ধ করে দিলে ওরা পেট ভরে খেতে পারবে। ওর কান্না, আকুতি আর মর্মবেদনা পুলিশ অফিসার ও তার সহকর্মীদের বেদনায় ডুবিয়ে দিলো।

অফিসার চোখ মুছতে মুছতে মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা ফরহাদ হোসেনের হাতে দিলো। বললো- ভাই আমাদের অন্যায় হয়েছে, তোমাদের খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিলো। যাইহোক তুমি বাজারে গিয়ে চাল, ডাল কিনে বাসায় যাও। না জানি তোমার শিশু বাচ্চারা খিধায় কতো না কষ্ট পাচ্ছে। পুলিশ অফিসারের চোখের পাতায় তার দুটি শিশুর মুখ ভেসে ওঠে। পুলিশ অফিসারের দেখাদেখি অন্যান্য কনস্টেবলেরাও বললো- স্যার আমরাও কিছু সাহায্য করবো।

পুলিশ অফিসার বললো- তোমাদের মন চাইলে অবশ্যই সাহায্য করতে পারো।

সবাই নিজ নিজ মানিব্যাগ থেকে ফরহাদ হোসেনকে কিছু কিছু টাকা দিলো। পুলিশ অফিসার বললো- ভাই কষ্ট দেওয়ার জন্য মাফ করে দিও। আমার ফোন নম্বর নাও। কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন দিও। এখন তুমি চাল, ডাল কিনে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও।

ফরহাদ হোসেন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো এবং পুলিশ অফিসারদের জন্য দোয়া করতে করতে ভ্যান নিয়ে দৃষ্টির অগচোরে চলে গেলো। পুলিশগুলো বিষণœ বদনে উদাস নয়নে ফরহাদ হোসেনের চলে যাওয়া অবলোকন করলো।

বিলের মধ্যে ফেলে দেওয়া সেই পঁচা কাঁঠালের বিচি থেকে কতগুলো কাঁঠালের চারা হয়েছিল সে খবর আর নেওয়া হয়নি।

লেখক : সহ- সভাপতি, খুলনা সাহিত্য পরিষদ

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!