খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ পৌষ, ১৪৩১ | ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ১৮১ আরোহী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান বিধ্বস্ত, জীবিত মাত্র ২

ঋণের বোঝা কাধে নিয়ে শুটকি আহরণে সুন্দরবনের চরে জেলেরা

মোঃ মেহেদী হাসান, রামপাল

ব্রিটিশ আমল থেকে সমুদ্রগামী শুটকি পল্লীর জেলারা জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মৎস্য আহরণ করলেও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেনি রামপালের জেলে পরিবারগুলো। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে ইতিমধ্যে পুঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে চড়াহারে মহাজনদের সুদের মাশুল গুণে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা শুটকি পল্লীর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে মগ বা সন্দীপ ও চট্রগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা সুন্দরবনের চরে অস্থায়ী বাসা তৈরি করে মৎস্য আহরণ করতো। আশির দশক থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ফিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুটকির জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন। সেই থেকে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে জেলেরা মৎস্য আহরণ করে আসছে। জেলারা ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বনরক্ষীদের হয়রানির মধ্যেও তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৩২৫ জন শুটকি পল্লীর জেলেদের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা বনবিভাগ রাজস্ব আদায় করেন। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৭৮৭ জন শুটকি পল্লীর জেলেদের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮ টাকা সরকারিভাবে আদায় করা হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় বেড়ে ২৭ লাখ টাকারও বেশী রাজস্ব আদায় হয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। এবারও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সমপরিমাণ কিংবা তার চেয়ে বেশী রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে বলে বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

সরকার ও বনবিভাগের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সুন্দরবনের দস্যুমুক্ত করায় ও বনবিভাগের অসাধু সদস্যদের হয়রানি কিছুটা বন্ধ হওয়ায় এবং নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবন ও উপকূলীয় শুটকি পল্লী থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাগেরহাট জেলার রামপাল, মোংলা, শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক বহরদার ও পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও কয়েকশত জেলে সাধারণত সুন্দরবন থেকে মৎস্য আহরণ করে থাকেন। প্রতি জেলে বহরদার সুদে মহাজনদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকেন। এতে ৫ শত জেলে বহরদারের বিপরীতে সুদে মহাজনদের কাছ থেকে অবৈধ পন্থায় ৫ কোটি টাকারও বেশী ঋণ নিতে হয়। ওই ঋণের বিপরীতে প্রতি লাখে সুদ গুণতে হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। অথচ তফশীলি ব্যাংক থেকে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হলে তাদের অনেক সাশ্রয় হয় বলে জেলেরা জানান।

জেলেরা আরও জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ করে সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব দিলেও জেলেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি। মৎস্য সমিতির মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায়, চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী বা ভাসমান হাসপাতাল না থাকায় ঝড় ও জলোচ্ছাস থেখে রক্ষার জন্য সাইক্লোন সেল্টার ও সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলেদের। গত ৪০ বছর ধরে সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু কোন সরকারই তাদের কথা রাখেনি। বিগত ও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী এমপি ও মন্ত্রীরা এবং সরকারে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আশ্বাসের পর আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কেউ তা কখনও পূরণ করেননি।

সমুদ্রগামী জেলে পল্লীর সভাপতি ও রামপাল সদরের বাসিন্ধা শহিদ মল্লিক জানান, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা কোন সাহায্য সহযোগীতা পাই না। প্রতি বছর মন্ত্রী-মিনিষ্টার ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং সমাধানের জন্য আশ্বাস প্রদান করেন। আজও পর্যন্ত আশ্বাসের কোন সুফল আমরা পাইনি। সুন্দরবনের জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায়সহ আসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বন্ধ হলেও এখনও সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত আমরা।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা প্রতিবছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব সরকারকে দেই। কিন্তু আমরা সহজ শর্তে কোন ঋণ পাই না, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই, সুপেয় পানির অভাব। এমনকি প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়ার মত কোন ব্যবস্থা ও নেই। জেলেদের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণসহ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান।

এ বিষয়ে সেভ দ্যা সুন্দবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, সুন্দরবন আমাদের প্রকৃতিক রক্ষা কবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মায়ের মত আগলে রেখেছে। কিন্তু আমাদের লোভের বলি হয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এ বন। এ বনকে রক্ষা না করলে আগামীতে এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন হতে পারে। এজন্য বনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম রক্ষায় সরকারি বেসরকারিভাবে সকলকে সমান উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসতে হবে। জেলেরা যাতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে শুটকির জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তিনি সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান।

এ বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও মুহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। এ বনকে আমাদের বনবিভাগের চৌকস বাহিনী দিয়ে নজরদারীর আওতায় আনা হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে গোটা সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রলিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালসহ অন্যান্য পেশাজীবিরা নির্বিঘ্নে বনজ সম্পদ আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বনের সুরক্ষা নিশ্চিতে তিনি সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!