খুলনা, বাংলাদেশ | ২২ মাঘ, ১৪৩১ | ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  সুইডেনে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে বন্দুকধারীর গুলিতে ১০ জন নিহত
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জমা আজ

উপজেলায় যাবে বিচারিক আদালত, বিভাগে হাইকোর্ট

গেজেট ডেস্ক

নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে প্রচলিত ভ্রাম্যমাণ আদালতকে (মোবাইল কোর্ট) বিচার বিভাগের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। বিচার বিভাগ সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশে বলা আছে, ‘যদিও মোবাইল কোর্ট চলমান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সাময়িক সাজা ও অর্থদণ্ড দিতে পারেন। এটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে।’

কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে আজ বুধবার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হচ্ছে। এর আগে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিতে একাধিকবার সময় বাড়ায়। অংশীজন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে প্রায় চার মাস পর বিচার বিভাগের জন্য এ-সংক্রান্ত ‘৩০টি’ সংস্কার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন।

সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত সুপারিশে উপজেলা সদরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতসহ লিগ্যাল এইড কার্যক্রম সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের স্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ গঠনেরও কথা থাকছে তাদের প্রস্তাবে। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিচার বিভাগ সংস্কারের খসড়া সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ২০০৯ সাল থেকে দেশে পরিচালিত হয়ে আসছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আসামির দোষ স্বীকার সাপেক্ষে এই আদালতের সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। তবে প্রায়ই এ আদালতের রায় নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই আদালত পরিচালনার অনেক অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই জমা হয়ে আছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে পর্যায়ক্রমে এই আদালতকে বিচার বিভাগের অধীনে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ২০১৭ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বৈধতা নিয়ে তিনটি রিটের শুনানি হয়। এতে মোবাইল কোর্ট আইনের ১৭টি ধারার মধ্যে ১১টি ধারা-উপধারাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। রায়ে বলা হয়, মোবাইল কোর্ট চলবে, কিন্তু সেটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা পরিচালনা করতে পারবেন না। কারণ, তারা বিচারক নন। এটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে পরিচালনা করা যেতে পারে। তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে আপিলটি।

উপজেলায় আদালত সম্প্রসারণ

উপজেলা বা থানা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে কোথায় আদালত স্থাপন করা প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে যেসব স্থানে চৌকি আদালত আছে, সেগুলো সচল রাখার প্রয়োজন আছে কিনা বা সেগুলোর ভৌগোলিক এখতিয়ার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন আছে কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণ

বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণ বিষয়ে খসড়া সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, প্রতিটি স্থায়ী বেঞ্চ কোন কোন এলাকা থেকে উদ্ভূত মামলা গ্রহণ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তবে বিচারকাজ পরিচালনা এবং রায়, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা বজায় রাখতে হবে।

অর্থাৎ স্থায়ী বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে দেশব্যাপী কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে বিভাজিত হবে না এবং রাষ্ট্রের একক চরিত্র ক্ষুণ্ন হবে না। এর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ তাদের নিকটতম স্থায়ী বেঞ্চে মামলা করার সুবিধা পাবে।
আরও বলা হয়েছে, সব স্থায়ী বেঞ্চ একই সঙ্গে কার্যকর করা কঠিন বিবেচিত হলে প্রয়োজনে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সদরদপ্তরগুলোতে স্থায়ী বেঞ্চ কার্যকর করা যেতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয়

পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণে আলাদা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন করতে হবে। সে জন্য একটি স্বতন্ত্র আইন বা অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হবে। ইতোমধ্যে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে একটি ধারণাপত্রসহ বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠনের সুপারিশ

প্রধান বিচারপতি ছাড়া সর্বোচ্চ আদালতের উভয় বিভাগে বিচারক নিয়োগের জন্য পৃথক কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে খসড়ায়। এতে বলা হয়েছে, ‘বিচারক নিয়োগে এককভাবে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিধান প্রচলিত আছে। এ পদ্ধতির পরিবর্তে যথাসম্ভব স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধা, সততা ও দক্ষতার মূল্যায়নকারী একটি কমিশনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নিয়োগ-পদ্ধতি প্রবর্তন করা বাঞ্ছনীয়।’ সেই লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘সুপ্রিম কোর্ট জাজেস অ্যাপয়েনমেন্ট কমিশন’ (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন) নামে একটি কমিশন গঠন প্রয়োজন।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারক নিয়োগে পরামর্শ

বিচারাধীন অতি পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির সুপারিশ করেছে কমিশন। এ জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে সাম্প্রতিক সময়ে অবসরে গেছেন– প্রতি জেলায় এমন এক বা একাধিক বিচারককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কমিশন।

স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন

রাষ্ট্রীয় মামলা পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্থায়ী ও স্বতন্ত্র সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের আইন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের মান সন্তোষজনক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে। প্রস্তাবিত স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসকে একটি পেনশনযোগ্য স্থায়ী সরকারি চাকরি হিসেবে বিবেচনার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়ায়।

স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠন

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলার গতি-প্রকৃতি এবং ফলাফল প্রাথমিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভরশীল। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়। কমিশন মনে করে, প্রচলিত তদন্ত ব্যবস্থা এবং নিয়োজিত জনবলকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত প্রক্রিয়ার যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন।

বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পদক্ষেপ

বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে তিন বছর পরপর সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পাঠানো এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনগণের সামনে প্রকাশ করা, জেলা পর্যায়ের আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে কয়েকটি প্রস্তাব রাখা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বাণিজ্যিক আদালত

বাণিজ্যিক আদালত স্থাপনের বিষয়ে খসড়া সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বাণিজ্যিক আদালত স্থাপনে যথাযথ বিধানসংবলিত আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং দেওয়ানি কার্যবিধিসহ অন্যান্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। সালিশ আইন সংশোধন করে সালিশ-সংক্রান্ত বিষয়াদি (আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশ ছাড়া) বাণিজ্যিক আদালতের ওপর ন্যস্ত করা বাঞ্ছনীয়।

সূত্র জানায়, কমিশনের সুপারিশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা ও অপসারণ, আলাদা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন এবং বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, জমে থাকা পুরোনো মামলার নিষ্পত্তি বা মামলাজট কমানো, বাণিজ্যিক আদালত স্থাপন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা, বার কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করা এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ নিষ্পত্তিতে স্থায়ী কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন, সর্বোচ্চ আদালত ও জেলা আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস (পরিষেবা) গঠন এবং এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষ জনবল কীভাবে নিয়োগ করা যায়, কমিশন সে ব্যাপারে দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের কথাও বলেছে।

প্রতিবেদন প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান বলেন, সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে– প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ থাকবে। কমিশনের পক্ষ থেকে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের স্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন ও উপজেলা পর্যায়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতসহ লিগ্যাল এইড কার্যক্রম সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি, চুক্তিতে বিচারক নিয়োগ, বাণিজ্যিক আদালত স্থাপন, মোবাইল কোর্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা বা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব কিনা বলতে পারছি না।’

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!