খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ আষাঢ়, ১৪৩১ | ২৬ জুন, ২০২৪

Breaking News

  নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বুড়িগঙ্গা নদীতে জাহাজের আগুন নিয়ন্ত্রণে
  হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ট্রাকচাপায় পুলিশ সদস্য নিহত

উপকূলের তথ্য দিতে না পারলে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার থেকে লাভ কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

গত ২৬ মে রাত ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে। যার তাণ্ডব চলে রাত পৌনে ৪টা পর্যন্ত। এসময় সাংবাদিকরা ঝড়ের গতিবেগ ও অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য বারবারই যোগাযোগ করছিলেন সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসে। কিন্তু সেখানে কর্মরত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন উপকূলীয় এলাকা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন ধারণা নির্ভর।

২৬ মে রাত ১২টায় সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপনের সাথে যোগাযোগ করে ঝড়ের তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাতক্ষীরা শহরে সর্বোচ্চ ৭২ কিলোমিটার বেগে ঝড় প্রবাহিত হচ্ছে। উপকূলে এই বেগ ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার হতে পারে।

তখন জানতে চাওয়া হয়, উপকূলে বয়ে যাওয়া ঝড়ের প্রকৃত বেগ কত? অনেকটা নিরুপায় হয়ে তিনি বলেন, আমরা তো শুধু সাতক্ষীরা শহরেরটা নির্ণয় করতে পারি। উপকূলে তো আমাদের কোনো স্টেশন নেই। তখন আবারও প্রশ্ন করা হয়, আপনারা ওখান থেকে অন্য কোনো মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন কি না? উত্তরে তিনি বলেন, না।

এমন পরিস্থিতিতে আবহাওয়া জলবায়ু ও দুর্যোগের প্রকৃত পূর্বাভাস পেতে শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকায় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার স্থাপনের দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা। তাদের প্রশ্ন, উপকূলের তথ্য দিতে না পারলে শহরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার থেকে লাভ কী?

স্থানীয়রা জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর বঙ্গোপসাগরের অতি নিকটবর্তী হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়, লঘুচাপ, নিম্নচাপ লেগেই থাকে। দুর্যোগপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও সঠিক পূর্বাভাসের অভাবে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় জনপদ।

শ্যামনগর উপজেলা দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) টিম লিডার শেখ মাকসুদুর রহমান মুকুল বলেন, বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগ ও আবহাওয়ার তথ্য ঢাকা থেকে সংগ্রহ করতে যে সময় লাগে, ততক্ষণে আবহাওয়া অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই শ্যামনগরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার বা দুর্যোগ সতর্কীকরণ কেন্দ্র স্থাপন জরুরি।

সিডিও ইয়ুথ টিমের পরিচালক গাজী আল ইমরান বলেন, আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট কোনো অফিস না থাকায় জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় আমাদের। বিভিন্ন সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমাদের সংগঠনের সদস্যরা কাজ করে। সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য না পেয়ে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। মানুষ আমাদের কাছে শুনলে আমরা সঠিক তথ্য দিতে পারি না। স্থানীয় লোকজনও ঝড়ের সময়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বললে অনীহা প্রকাশ করে। শহরে আবহাওয়া অফিস রেখে লাভ কী? দেশের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্যোগপ্রবণ প্রতিটি এলাকাতেই আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র বা দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

স্থানীয় সংবাদকর্মী জুবায়ের মাহমুদ বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে । এতে জানমালের অনেক ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসে ফোন দিলে সেখান থেকে সাতক্ষীরা শহরের ঝড়ের খবর দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ শ্যামনগর উপজেলার তথ্য সেখান থেকে মেলে না। যার ফলে সংবাদকর্মীরাও সঠিক তথ্য পায় না।

প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ জানান, প্রতিবছর কোনো না কোনো দুর্যোগে বঙ্গোপসাগরের অতি নিকটবর্তী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর এই দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তার বড় মাধ্যম হলো আবহাওয়া অফিস বা দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্র। যেটি এই উপকূলীয় অঞ্চলে নেই। এর ফলে সঠিক তথ্য না পেয়ে বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে এ অঞ্চলের মানুষের জনজীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়সহ আবহাওয়া পূর্বাভাসের দুইটা ধরন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তার একটি হচ্ছে লোকায়িত আবহাওয়া পূর্বাভাস জ্ঞান- এটা হচ্ছে স্থানীয় মানুষ অনেক কিছু দেখে বুঝতে পারে যে কখন বৃষ্টি হবে, কখন ঝড় হবে বা সুনামি হবে। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এটা একটা পদ্ধতি। আর একটা হচ্ছে যেটা আমরা আবহাওয়া অফিসের মাধ্যমে বা আমরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বুঝতে পারি। এখন লোকায়িত আবহাওয়া পূর্বাভাস জ্ঞান ও প্রাতিষ্ঠানিক আবহাওয়ার জ্ঞান এই দুইটার মধ্যে সমন্বয় জরুরী। এটা হল আমার প্রথম প্রস্তাব।

দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়া পূর্বাভাসের যে কেন্দ্রগুলো আছে সেই কেন্দ্রটির একটি অবশ্যই সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মত জায়গাতে হওয়া উচিত। যেখানে সুন্দরবন এবং বিভিন্ন সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রথমে আঘাত করে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালও আঘাত করেছে প্রথমে শ্যামনগরে। এজন্য আসলে এ অঞ্চলে একটি আবহাওয়া কেন্দ্র হওয়া উচিত। এক্ষেত্রেও আমার প্রস্তাব হলো, এই কেন্দ্রকে লোকায়িত আবহাওয়া পূর্বাভাস জ্ঞান ও প্রাতিষ্ঠানিক আবহাওয়া পূর্বাভাস জ্ঞান একত্রিত করে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরী।

তৃতীয় প্রস্তাব হচ্ছে, শুধুমাত্র আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন করলে হবে না নিয়মিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষক, জেলে, বনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী সবার মধ্যে নিয়মিত ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রচারটা জরুরী, যাতে আমরা সকলে নিতে পারি।

সাগরে মাছ ধরা ট্রলার চালক শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী এলাকার শামসুর গাজী বলেন, সঠিক সময়ে ও স্থানীয়ভাবে সংকেত না পাওয়ায় গভীর সাগরে থাকা জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে। সংকেত না জেনে তারা ঝড়ের মধ্যে সুন্দরবনসহ ঝুঁকিপূর্ণ সাগর এলাকায় আশ্রয় নেন। অনেক সময় ভাসতে ভাসতে ভারতেও চলে যায়। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের এই উপকূলীয় অঞ্চলে আবহাওয়া অফিস না হয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন অতি জরুরি।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই উপজেলায় আবহাওয়া অফিস হলে আগে থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব হবে। এতে করে কৃষকরা ফসলের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন।

শ্যামনগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার বলেন, এ উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ মৎস্য চাষ ও নদীতে মাছ ধরে জীবনযাপন করে। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই উপজেলায় আবহাওয়া অফিস বা দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন হলে আগে থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব হবে। এতে তারা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারবে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ -১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাউদ্দিন বলেন, বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাউবোর বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য আগাম না জানতে পেরে অনেক সময় প্রস্তুতি নিতে একটু দেরি হয়ে যায়। আবহাওয়ার সঠিক তথ্য আগাম পেতে উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর ও আশাশুনির জন্য পূর্বাভাস কেন্দ্র বা দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরী।

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসি এফ) এম কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, দুর্যোগের সময় আবহাওয়ার সঠিক তথ্য না পেয়ে সুন্দরবন নির্ভরশীল অনেক জেলে বাওয়ালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও আমাদের সুন্দরবনের ভেতরে ১২টি টহল ফাঁড়ি রয়েছে। তাদেরও সঠিক সময়ে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য দেওয়া যায় না। এর ফলে বিভিন্ন সময়ের তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্যোগপ্রবণ ও সুন্দরবন কেন্দ্রিক এই উপকূলবর্তী এলাকায় আবহাওয়া অফিস স্থাপন খুবই জরুরী।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি.এম মাসুদ আলম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের এই এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামান্য দুর্যোগের খবর এলেই আমাদের এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। আমরা দুর্যোগের খবর মানুষের মাঝে প্রচার করেত পারি না। সঠিক খবর না পাওয়ায় আমাদের এই এলাকার মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগে থেকে যদি সঠিক খবর জানা যায় তাহলে আগাম সতর্ক হওয়া যায়। এক্ষেত্রে আমাদের শ্যামনগরের এই উপকূলীয় অঞ্চলে একটি আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র খুবই জরুরী। এটি হলে আমাদের এই এলাকার জেলে, বাওয়ালী, কৃষকসহ সকলে উপকৃত হবে।

শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক সাঈদ উজ-জামান সাঈদ বলেন, শ্যামনগরে দুর্যোগ লেগেই থাকে। আবহাওয়া অফিস থেকে সঠিক তথ্য না পেয়ে এ উপজেলার মানুষ আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে না। আমাদের দাবি দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এলাকা হিসাবে শ্যামনগরে দ্রুত আবহাওয়া অফিস স্থাপন করা হোক।

সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস.এম আতাউল হক দোলন বলেন, দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে আমি গুরুত্ব দিয়ে কথা বলব। দ্রুত যাতে এই এলাকায় একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন করা যায় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!