বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহামারি করোনার কারণে সাতক্ষীরার চিংড়ি চাষিদের যেন দুর্দিন কাটছে না। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদী ভাঙ্গনে মাছের ঘের প্লাবিত হওয়ায় চিংড়ির সাতক্ষীরার চাষিদের কপালে উঠেছে চিন্তার ভাঁজ। ঠিক সেই সময় উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে আধা নিবিড় পদ্ধতি।
সাতক্ষীরার উপকূলী শ্যামনগর উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চলতি বছর আধা-নিবিড় (সেমি ইনটেনসিভ) পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করে সফল হয়েছেন ওই এলাকার চিংড়ি চাষিরা। সাধারণ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে যে উৎপাদন হয়, তার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বলে জানান মৎস্য চাষিরা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, পাঁচ বছরে জেলায় রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ১৪৬ টন। এর মধ্যে বাগদা চিংড়ি এক লাখ ১৮ হাজার ৩০৮ টন। গলদা চিংড়ির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৮৩৭ টনের মতো। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৫ হাজার ৩৫৪ টন বাগদা ও ৬ হাজার ৩৪ টন গলদা চিংড়ি। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ হাজার ৪৮৫ টন বাগদা ও ৬ হাজার ১০৬ টন গলদা, ২০১৭-১৮ বাগদা ২০ হাজার ৯৪১ টন ও গলদা ৬ হাজার ৫২৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা ২১ হাজার ৪৪১ টন ও গলদা ৬ হাজার ৫৪২ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৮৭ টন বাগদা ও ৮ হাজার ৬৩০ টনের মতো চিংড়ি উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এসব চিংড়ির রপ্তানিমূল্য ৭ হাজার ৬০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জেলায় বছরে প্রায় ৬০ হাজার নিবন্ধিত ঘেরে চিংড়ি চাষ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, জেলার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের ২৫ জন চিংড়ি চাষি আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করে সফল হয়েছেন। কমিউনিটি বেজড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ফিশারিজ অ্যান্ড একুয়াকালচার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ, মৎস্য অধিদপ্তর, জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার যৌথ এক প্রকল্পের মাধ্যমে উৎসাহিত হয়ে এ চাষে মনোনিবেশ করেন তারা। এ পদ্ধতিতে একটি এক বিঘা মৎস্য ঘেরে প্রায় ১২ হাজার চিংড়ি পোনা ছাড়া যায়। যা প্রায় ৪ মাসের মাথায় বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে। গত বছর থেকে এই পদ্ধতিতে উপকূলের কিছু চাষি চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। যা উৎপাদিত হয়েছে পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন। সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে হেক্টরপ্রতি ৩০০-৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো, সেখানে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে উৎপাদন পাঁচ হাজার কেজি ছাড়িয়ে যায়।
শ্যামনগরের আধা নিবিড় চিংড়ি চাষি মিজানুর রহমান জানান, প্রাথমিক ভাবে তিনি এ চাষ শুরু করেন। প্রথমে ভয় কাজ করলেও পরবর্তীতে তা কেটে গেছে। পূর্বের চাষ পদ্ধতির থেকে তিনি বেশি উৎপাদন পেয়েছেন। যা উৎপাদন হয়েছে রীতিমত স্থানীয়দের মাঝে সাড়া পড়েছে বলে জানান তিনি।
দেবহাটা এলাকার চিংড়ি চাষি মাহমুদুল হক লাভলু বিশ্বাস জানান, অনেক আগে থেকেই তিনি আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে আসছেন। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হলেও এখন আর সমস্যা হচ্ছে না। তাদের এ সাফল্য দেখে এ অঞ্চলের চিংড়ি চাষীরা অল্প জমিতে অধিক উৎপাদনের আশায় আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন।
এব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার জানিয়েছেন, আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করলে সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে চাষিরা বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ করতে পারবেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান বলেন, রপ্তানিজাত চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ উৎপাদনে সাতক্ষীরা খুবই সম্ভাবনাময় একটি জেলা। এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়া সব ধরণের মাছ চাষের উপযোগী। প্রতি বছর এ জেলায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার চিংড়ি অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি রপ্তানি করা হয়। মাছ চাষের সঙ্গে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ সরাসরি সম্পৃক্ত।
তিনি আরো বলেন, বাগদা চাষে এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে বাগদার পোনা টিকিয়ে রাখা। তবে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে সঠিক নার্সিংয়ের মাধ্যমে পোনার মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। গতানুগতিক পদ্ধতি পরিহার করে উপকূলের চিংড়ি চাষিরা আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে অনেক বেশি লাভবান হওয়ায় চিংড়ি চাষে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
খুলনা গেজেট/ টি আই